পর্ব দুই
লেখকঃ মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান (এডভোকেট)
……স্যারের সাথে ঐ গ্রাম্য শ্লোকের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে গিয়ে দেখলাম যে, উনার স্থানীয় লোকদের সম্বন্ধে জানা শুনা অনেক গভীর। মানুষের নাম মুখে নিলে বলে দিচ্ছেন ওর গায়ের রং ও গড়ন। এটা হতে পারে দীর্ঘ দিন নিজের এলাকায় থেকে শিক্ষকতা করেছেন এবং মাটি ও মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এই শ্লোকের আরব উল্লা সাহেব হলেন উনারই ছাত্র আজাদ ( লন্ডন প্রবাসী ) এর পূর্ব পুরুষ, বাউর বাগ গ্রাম নিবাসি।
মান উল্লা সাহেব বাকি সব হিন্দু জমিদারদের মত গ্রাম পরিত্যক্ত। উনার প্রজন্ম পাশের গ্রামে আছেন এবং উনার সম্বন্ধে আরও অধিক তথ্য জানার চেস্টায় লিপ্ত আছেন বলে জানা যায়।
শ্রীধর পুর গ্রামের আকাই নামক এক লোক ডেকা ( ষাঁড়) পালন করতেন লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে এবং এর বেশ সুনাম ছিল।
অত্র এলাকার পয়গম্বর পুর গ্রামের সব্দর মুহাম্মদের বাড়ি ঘরের অবস্তার বেগতিক দেখে লোকজন মেনে নিতে পারে নাই, তাই ঐ বাড়ির এমন নাম করন হয়েছিল।তার থেকে একটা জিনিষ পরিষ্কার হচ্ছে যে এলাকার মানুষ পরিষ্কার পরিচ্চনতার ব্যপারে সচেতন ছিল।
কাকৈর কোনা গ্রামের অক্ষয় মহাজন দের কাচা টাকার ঝন-ঝনানি ছিল, এই জন্য এর এমন নাম ।
পয়গাম্বর পুর গ্রামের মুনশি বাড়ি বলতে ধন মেসাবের (মৌলানা) বাড়ি খুবই কাঁদা যুক্ত ছিল। এই জন্য এমন নামকরন।
গ্রাম্য এলাকায় তখন কিচ্চা কাহিনির আড্ডা বসত। হানিফ উল্লা ও সইফ উল্লা নামক দুটি লোক আড্ডায় গল্প কিচ্চা বলার জন্য তৎকালে জনপ্রিয় ছিল।
আমি ধীরে ধীরে উনাকে জানার যত গভীরে যাচ্ছি মনে হচ্ছে এই সব লোকের সানিধ্যে কেন ছাত্র বয়সে পেলাম না। যদি সেই সময়ে পেতাম তাহলে জীবনটা আরও আলোকিত হতে পারত।
মনে মনে একটা ধারণা জন্মে গেল অবশ্যই উনি গুণী পিতার সন্তান হবেন। সেই সাথে মনের গভীরে জানার ইচ্ছা হল উনার পরিবার সম্বন্ধে। তাই প্রশ্নটা না ছুড়ে পারলাম না।
স্যার আপনার বাবা কি করতেন ? আপনারা ভাই বোন কয় জন ?
আমার বাবা মহেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। আমার এক বড় ভাই ছোট বয়সেই মারা যান এর পর আমি ও দুই বোন। এক বোনকে বিয়ে দেয়া হয়েছে আমার এলাকায় এবং ছোট বোনটার বিয়ে হয়েছে সিলেটের মোগলা বাজারের কাছা কাছি এক গ্রামে।
স্যার জানতে পারি কি আপনার মায়ের দেশ কোথায় ?
আমার মামার গ্রাম কাঠাল খাই, জগন্নাতপুর, সুনামগঞ্জ।
স্যার আপনার কলেজ শিক্ষা কেমন ছিল ?
আমার উচ্চ মাধ্যমিকটা পড়া হল আমার নিজ শহরে, মৌল্ভী বাজার কলেজে। পাশের সাল ছিল ১৯৬০।
আমার ডিগ্রী ক্লাসে ভর্তি হতে পড়লাম এক বিড়ম্বনায়।আমি সিলেটের এম.সি কলেজের ভর্তির ডেড লাইন মিস করে পেললাম। তাই অগত্যা আমাকে সুনাম গঞ্জ কলেজে থেকে ১৯৬২ সালে ডিগ্রী পাশ করতে হয়। তার পর চলে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার তো শুনে ভীষণ ভালো লাগছে তৎকালীন সময়ে আমার এলাকার অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করেছেন ।
স্যার আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা কেমন কেটেছে ? আপনার সহ পাঠিরা কে কে ছিলেন ?
আমি জগন্নাথ হলে থাকতাম। আমার সহপাঠি ছিল প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও পারলামেন্টেরিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। আমরা এক সময় একি রুমও শেয়ার করেছি। ওর নাটকের প্রতি বেশ ঝুক ছিল। সে প্রথম দিকে এ নিয়েই ব্যাস্ত থাকত। আমি ছিলাম শুরু থেকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত। আমি গর্ব বোধ করি যে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দলনে যোগদান করতে পেরছিলাম বলে। সুরঞ্জিত অবশ্যই পরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পরে। আমার সাথীদের মধ্যে ছিল বিশেষ মেধার অধিকারি আকবর আলি খান। যার ছিল দুইটি মাস্টার ডিগ্রী। ইতিহাসে সে আমাদের সাথে ১ম শ্রেনিতে ১ম হয়েছিল।তার আবার অর্থনীতিতে ২য় মাস্টার ডিগ্রী নিয়েছিল। এই সেই ডঃ আকবর আলি খান যে পাকিস্তানের স্বনামধন্য সি.এস.পি. অফিসার ছিল। বাংলাদেশে সে মন্ত্রী পরিষদের সচিব হয়ে অবসরে গিয়েছিল। আমার আরেক সহপাঠী ছিল E.P.C.S , ফরিদ পুরের মানিক সমাদ্দার।
সে অতিরিক্ত সচিব হয়ে অবসরে যায়। স্যার আমি তো জানতাম পাকিস্তান আমলে যারা সিভিল সার্ভিসে ঢুকেন সবাই সি. এস. পি. অফিসার এখানে ই. পি. সি. এস মানে কি?
একটা পরীক্ষা ছিল পুরো পাকিস্তান নিয়ে (C.S.P) এবং অন্যটা শুধু ইস্ট পাকিস্তান নিয়ে ( E.P.C.S)। ধন্যবাদ স্যার।
স্যার আপনারা কবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেন এবং আপনি কি সি,এস,পি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ?
আমি ইতিহাসে মাস্টার্স করে ১৯৬৫ তে বের হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত এই বছরে ইন্ডিয়া পাকিস্তান যুদ্ধ বেঁধে যায়। আমি পারলাম না সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফর্ম সংগ্রহ করতে। আমাকে দেওয়া হল না। কেন স্যার ? ঐ যে যুদ্ধ ! যুদ্ধের সাথে এর কি সম্পর্ক ? তবে কি আপনি হিন্ধু বলে দেওয়া হয় নাই ? স্যার বললেন সেটাই তো, নয়ত আর কি ?
আমার ভাবনা চলে গেল অনেক অনেক দূরে !!! আমাদের এই প্রান্তর বহুবিধ সীমারেখায় বিভিক্ত হয়ে চালিয়েছে মানবতার বুকে অহরহ ছুরিকাঘাত।
বড় কষ্ট লাগল স্যারের এ কথা শুনে। এর পর জীবন কোথায় নিয়ে গেল একটু কি বলবেন স্যার?
আমাদের সময়ে চাকুরির খবর পাওয়াটাই ছিল বড়ই আরাধ্য। মৌলভী বাজারে পত্রিকা আসতে আসতে দুদিন দেরি হয়ে যেত ও অনেক সময় আসতও না। তাই সব চাকুরীর সংবাদ পেতাম না সময় মত। যখন পত্রিকা হাতে আসত অনেক চাকুরীর আবেদনের সময় শেষ হয়ে যেত। যাই হোক শিক্ষকতার চাকুরী খুজছি। আমাদের এলাকার যে চারটি কলেজে ছিল মৌলভী বাজার, হবি গঞ্জ, সুনাম গঞ্জ ও সিলেট তাতে কোন পদ খালি নেই। দু’টা চাকুরীর নিয়োগ পেলাম, চাকার ফজলুল হক কলেজ, বরিশাল ও শ্রিকাইল কলেজ কুমিল্লা থেকে। কিন্ত বাবা আমাকে দূরে যেতে দিবেন না, এবং যোগাযোগ ব্যবস্তা ছিল খুবই দুর্গম। ইতি মধ্যে এলাকার লোকজন বিশেস করে মনু মুখ স্কুল কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ড চাম্পা লাল শান্ড ও সেক্রেটারি পাগুড়িয়া গ্রামের মনু মুখ বাজারের বিশিষ্ট বেবসায়ি আব্দুর রহামান খান সহ কমিটির অন্যান্য সদস্যরা আমাকে খুব শক্ত ভাবে ধরেছেন মনু মুখ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। দেখলাম বাবার সায় আছে সেথায়, তাই ১৯৬৭ সালে যোগ দিলাম।

তাছাড়া আমি মৌলভী বাজার মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। শুরু করেছিলাম ৮ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯৮৫ সালে। আমি যখন চলে আসি ১৯৯৭ সালে, রেখে এসেছিলাম শত শত ছাত্রী। উক্ত কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাদের নাম বিশেষ ভাবে আমি স্মরণ করতে চাই তাদের মধ্যে জনাব এডভোকেট নজমুল হক চৌধুরী। উনি আমারও সিনিয়র ছিলেন।খুবই প্রতিতযশা উকিল ছিলেন মৌল্ভী বাজার বারের। আমি যতটুকু জানি উনি এখন কানাডা প্রবাসী। উনি কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন এক্সিকিউটিভ কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। আরও অধিক স্মরণ করতে চাই আমার তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল খালিক সাহেব সহ অন্যান্য শিক্ষক মণ্ডলী।জেলা প্রশাসন ও শহরের গণ্যমান্য অনেকেই কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। যাদের একান্ত সহোযগিতা ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান স্তাপন করা সম্ভব হত না।
আমি আপনাকে আরেকটা কথা বলি। আমি কিন্তু মৌল্ভী বাজার জজ কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট। একি বলেন স্যার ? এক জীবনে এত কিছু ? একজন সার্থক হেড মাস্টার ও শিক্ষাবিধ অধ্যক্ষ হয়ে ঐ কঠিন কাজটা কবে সারলেন ?
আমি ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে ১ম পার্ট দেই ১৯৬৯ সালে এবং ফাইনেল পার্ট ১৯৭৩ সালে দিয়ে উকিল সনদ প্রাপ্ত হই ১৯৭৭ সালে। আমি বললাম স্যার ও আমি ও আপনি এই দিকে একি ল’ কলেজের ছাত্র।
আপনি কোন সাইটটা প্র্যাকটিস করেন? প্রথমত ইমিগ্রেশন ও পরে যখন ফুল টাইম কোর্ট এ গেলাম সিভিল ও ক্রিমিনেল দুইটিই করেছি। শুনে খুশি হলাম স্যার এই লাইনে তো আপনি আমার সিনিয়র কলিগ। আমিও স্যার ১৯৯১ এর সনদ প্রাপ্ত ও আপনার মত ইমিগ্রেসন দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার কর্ম স্থল ছিল সিলেট জজ কোর্ট। আমাদের আলাপচারিতায় একে অন্যের খুবে কাছে চলে যাচ্ছি।
স্যারের সাথে যতই কথা নিয়ে এগুচ্ছি উনার স্মৃতি শক্তির ধার দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারছি না। উনাকে নিয়ে আমার প্রাথমিক যে ধারণা ছিল সেটাই এখন প্রতিয়মান হচ্ছে। এই সব মহৎ প্রানই অবদান রেখে যান সমাজ ও মানবতার তরে। স্যারকে আরও বুঝতে ও জানতে আগ্রহ শুধু বাড়তেই লাগল।
চলবে ….
আগের পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন https://mahlondon.com/2020/10/16/%e0%a6%ab%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a7%8b%e0%a6%96%e0%a7%87-%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%96/