পর্ব তিন (শেষ পর্ব)
……… স্যার আপনার অবসর ও ভালো লাগার বিষয় গুলি কি, জানতে পারি ?
আমার অবসর মানেই মানুষ। মানুষের কল্যাণে যদি কিছু করা যায় সেটাই। তাই আমি ১৯৮৮-১৯৯৭ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলাম। বলেন কি স্যার !!!!! এমন ঝামেলা সম্পন্ন কাজে আপনি ? আমার কোন গত্যন্তর ছিল না মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করা যায় না। আর আমার সময়ে জেলার যে কোন পর্যায়ে গেলে যে কোন কাজ সম্মানের সহিত করিয়ে আনতে পারতাম। আমার এলাকা থেকে তো কোন মামলা মোকদ্দমা থানায় বা কোর্টে যেত না বললেই চলে। শুধু কি তাই, জেলার অন্যান্য দায়িত্ব দেবার জন্য উচ্চ পদের কর্ম কর্তারা সহোযগিতা করেছেন। যেখানে বিশেষ স্বচ্ছতার প্রয়োজন আমাকে সেখানে যেন থাকতেই হবে। জেলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এর সভাপতির দায়িত্বও নিতে হয়েছিল।
সিলেট বিভাগের মধ্যে একমাত্র আমিই শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যন হিসাবে ১৯৯৭ সালে রাস্টীয় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হই। এক আড়াম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান মন্ত্রী আমাদের হাতে সোনার পদক তুলে দেন।
এছাড়া আমাকে মৌলভী বাজার জেলা কমিউনিটি পুলিশের প্রথম প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এই শুধু শেষ নয় জেলা আইন শৃঙ্কলা কমিটিরও সদস্য ছিলাম। এত সব কেমনে হয় স্যার ? এই যে আপনি প্রশ্ন করেছিলেন আমার অবসর ও ভালো লাগা- এটাই আমার অবসর । স্যার মনে কিছু করবেন না আর কি কোন দায়িত্ব আপনাকে নিতে হয়েছিল? একটু হাসলেন, আমি জেলা হিন্দু, বৌদ্দ, ক্রিস্টান পরিষদের দায়িত্বে ছিলাম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলাম।
আমি স্যারের কর্ম ময় জীবনের ফিরিস্তি শুনে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কি সুন্দর মানবিক জীবন উনি করছেন যাপন। শিক্ষার সেবা, সরাসরি জনসেবা কি মহৎ জীবন। স্যারের সাংস্কৃতিক জীবনটা জানতে ইচ্ছে করছে।
তাহলে কি ধরে নিব ধর্ম ও সংস্কৃতির দিকে একটু কম দৃষ্টি পড়েছিল ?
ধর্ম বিশ্বাস ও চর্চার কস্মিনকালেও ঘাটতি হয়নি, উপোরন্তর ধর্মীয় ও সমাজ কাজে নিয়োজিত হতে হয়েছিল। মৌল্ভী বাজার কালি বাড়ি, চৌমুহনা ও রামকৃষ্ণ সেবা সমিতির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। একি সময়ে জেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ছিলাম।
আর সংস্কৃতির কথা বলছেন ?
উদীচীর সাথে তো আমার সম্পর্ক বহু আগেকার। জেলা উদীচীর সভাপতির দায়িত্বই তো আমার কাছে এক আনন্দ ধারা। এইতো এভাবেই জড়িয়ে ছিলাম জীবনভর।
স্যার আপনার জীবনতো খুবই সুন্দর, তেমন চড়াই উৎড়াই ছিল বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে না, তাই না স্যার ? শুধু আপনাকে ঐ যে জেন্ত চেপে মারার ক্ষন ছাড়া। আপনার শিক্ষা ও যোগ্যতার ও স্বপ্নের টুটি চেপে ধরা বৈষম্যমূলক রাষ্টিয় নীতি যার হেতু আপনি পান নি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফর্ম। তারপরেও এমন আলোকময় জীবন করলেন পার ! আমি সত্যিই অভিভূত। আপনাকে জেনে আমি গর্বিত।
আমার এই কথা শুনে স্যার ও আমার কথোপকথনের একটা ছন্দ পতন হল যেন। স্যার একটু স্তমিত হলেন মনে হল। তার পর বলতে শুরু করলেন।
এইতো আপনি নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে একটা অন্ধকার বিভীষিকাময় অধ্যায়ে। এই সব আলাপ করতে মন সায় দেয় না। চৌচির হৃদয়ের ক্ষতকে নাড়া দিতে হয়।
আমার গোষ্ঠীর অধিকাংশেরও বেশি মানুষ বহু পূর্বে ভারতে স্থায়ী নিবাস করে ফেলেছেন । আমার বাবাকে কেউ মানাতে পারেন নি দেশ ত্যাগে। উনার একটাই কথা মরতে হলে মরব জন্ম মাটিতে।তখন আত্মীয় স্বজন উনাকে তিরস্কার করে বলে গিয়েছিল, মরবে খাওয়া পানি পাবে না। তখন কি তোমার নারিকেল পাতা ও সুপারি গাছের পাতা খেয়ে বাঁচবে।
১৯৭১ সাল যুদ্বের বছর, ত্রাহি ত্রাহি অবস্তা । আমাদের জান যদি ধরে থাকে কিন্ত ধর চায় জান ছেড়ে পালাতে। এমন কঠিন সময়ের সম্মুখীন হলাম আমরা।
এমনি এক দিন আমার পরিষ্কার মনে আছে ২৭শে এপ্রিল ১৯৭১ সাল, মনু মুখ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি রসময় দত্ত আমার বাড়ীতে।আমাদের বাড়িটা ছিল সদর রাস্তার কিনারায়। উনি উনার পরিবার সহ ট্রাক যোগে ভারতে চলে যাচ্ছেন। উনি বাড়িতে ঢুকেই ভয়ানক গলায় বলতে শুরু করলেন, আপনারা এখন বসে আছেন কেন ? আমি খবর পেয়েছি কালকেই সিলেট থেকে আর্মি মার্চ করে মৌলভি বাজারের দিকে আসতেছে । রাস্তার পাশের সব হিন্দু ও যে গ্রামে আওয়ামিলীগ আছে ওদের বাড়ি ঘর ও গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানুষকে হত্যা করবে। পালাও আর কিসের অপেক্ষা। চলুন আমার সাথে। এই কথা শুনে আমার মা হাউ মাউ করে কেঁদে অস্তির হয়ে গেলেন। আমার দুইটা কচি বাচ্চার জন্য উনার চিন্তা। মেয়েটার বয়স তিন ও ছেলেটার বার বা চৌদ্দ মাস হবে। মা হাউমাউ করে কেঁদে ওদেরকে রশময় দত্তের সাথে নিরাপদে পৌঁছাবার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। হায়রে মায়ের জাত নিজের চেয়ে এখন নাতি-নাত্নির জন্য জান যায়। আমি অগত্যা আমার পরিবারকে ধর্ম নগর আমার সম্নধির বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে রসময় দত্তের ট্রাকে উঠলাম। আমি যে কি ভীষণ সমস্যায় পড়লাম, এই অবস্তার মধ্যেও মা বাড়ি ছাড়তে রাজি না।আমার তিন আত্মীয় ওর মধ্যে দুই জন যুবক ছিলেন তাদের তত্তাবদানের মাকে রেখে গেলাম।আমি পররে দিন ফিরে আসছি বলে গেলাম। আমার সম্পদ বলতে তিনটা ৫০০ টাকার নোট, আরও ২/ ১ টা ১০ টাকার নোট ছিল।ঘড়িটা হাতে লাগিয়ে টর্চ লাইটটা সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
বউ বাচ্চাকে সম্বন্ধী ( স্ত্রীর বড় ভাই ) এর বাসা ধর্ম নগরে রেখে মায়ের জন্য বাড়ির পথে পরের দিন ফিরছি । সাংবাদিক মতিউর রহমান, যিনি নেপ এর রাজনীতি করতেন পথিমধ্যে আমাকে আটকালেন। উনারা ভারতে যাচ্ছেন, আমাকে বললেন এক পা আর এগুবেন না, আপনি চান্নি ঘাট (মৌল্ভী বাজার) পৌছার আগেই গুলি করে মের ফেলবে। শহরে একটা বিড়াল কুকুরও নেই, আপনি আমাদের সাথে ফিরেন। অগত্যা তাদের সাথে আবার ভারত অভিমুখে চললাম। বারংবার ভয়ে গাঁ শিউরিয়ে উঠতেছিল, মা-র কথা স্মরণ করে। তার পরের মিনিট সেকেন্ড গুলো কেমন ছিল এবং কি ছিল সেটার ভয়াবহতা ও ট্রমায় আমি জীবনভর বিধস্থ হয়ে আছি।আমার কাছে সেকেন্ড গুলি বছরে পরিণত হয়েছিল, স্নায়বিক ও মানসিক বিপর্যস্তটা মৃত্যু অবধি ভোগাবে। এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায় নি বিগত ৫০ বছর থেকে। পৃথিবীর কোন কাউন্সিলিংই মুক্তি দিতে পারবে না তা থেকে।
স্যার কথা বলছেন ও হঠাৎ খাপ ছাড়া হয়ে ঘঠনার বর্ণনা থামিয়ে দিচ্ছেন বা থেমে যেতে চাচ্ছে। এই সব এখন আর মনে করলে মনটা যেমন কেমন হয়ে যায়। এই কথা বলে নিজের অজান্তেই যেন আবার একটা অব্যক্ত অপ্রকাশ্য জগতে ফিরে যেতে উদ্যত হন বলে আমার বোধগম্য হচ্ছিল। স্যার বেশ লম্বা কয়েকটা বিষাদের শ্বাস ফেললেন। আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম ,বার বার দুখ প্রকাশ করতে লাগলাম। আমি ভাবতে লাগলাম উনাকে এই বয়সে আবার কোন মানসিক কস্টে ফেলে দিলাম নাতো ? স্যারের চাপা বেদনার ভার আমাকে স্পর্শ করল। আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছি না। মানবতার যে বিপর্যয় গঠেছিল তা শুনে মুচড়ে পড়লাম।উনি বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন যে আমি বেদনায় পীড়িত হয়েছি। স্যারই আবার আমাকে সামলাচ্ছেন। আমি জানি বা বুঝি স্যার এই মুহূর্তে কি পর্যায়ে আছেন । আমার হালকা ট্রমাগ্রস্ত মানুষের সাথে প্রফেশনাল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
স্যার বলে চলছেন আমার অশান্তি ও অপেক্ষার পালা শুরু হল । মনে আবার স্বস্তিও জাগে যে, বাড়িতে রেখে আসা তিন জন পুরুষ লোক যারা আমকে আশ্বস্ত করেছিল আসন্ন বিপধ সঙ্কুরল পরিস্তিত হলে মাকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাবে।
যহেতু নিজে ফিরে যেতে পারিনি, তাই প্রতিদিন বর্ডারের বিভিন্ন কেম্পে মায়ের অপেক্ষায় ও উনাকে পেতে ঘুরা ঘুরি শুরু করে দিলাম। সেই থেকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কেম্পে মার সন্ধানে নির্ঘুম দিন পাত যাচ্ছিল। একদিন করিম গঞ্জ কেম্পে এক মহিলাকে দেখলাম গুড় মুড়ি খাচ্ছেন, আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে খবর দিলেন যে, আমার মা বেঁচে আছেন ও কিছু দিনের মধ্যে বাড়ির লোকজন নিয়ে ভারতে চলে আসবেন।মহিলার পরিচয় পেলাম উনারও মামার বাড়ি আমার মামার দেশে। আমাকে ছোট বেলায় দেখেছেন বিধায় চিনে ফেলেছেন।মনটা বড় হালকা ও শান্ত হল।
এই অবস্তায় সিদ্দান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্বে যোগ দিব । ধর্ম নগরে বউ বাচ্চা রেখে চলে গেলাম আগর তলা। যতারীতি নাম লিখিয়ে রিসিট নিয়ে বসে আছি দশ দিন পর দেরাধুন প্রসিক্কন শিবিরে যাব বলে। আমার অপেক্ষা কালীন সময়ে টেলিগ্রাম পেলাম যে, আমার মা আমার সম্নধির বাসায় এসে পৌঁছেছেন। আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেলাম মায়ের কাছে। আমি সেখানে গিয়ে মহা বিপত্তিতে পড়লাম, আর ফিরে আসা হচ্ছে না আগর তলা। আমার নিঃসন্তান বড় মামা বহু পূর্ব থেকেই বসবাস করে আসছিলেন গৌহাটি, মাকে নিয়ে সেখানে যেতে হবে।
আমারা ভারতে জয় বাংলার মানুষ হিসাবে পরিচিত।সেই যে এক করুণ যাত্রা। জয় বাংলার মানুষে আর ঠাই হচ্ছে না রাস্তা ঘাটে, চলা ফেরা বা গাড়ি ঘোড়া লোকে লোকারণ্য। আমাদের দুই আত্মীয় কোনভাবে আমাদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। তিল ধারনের ক্ষমতা নেই। মাকে কোন রখম একটা গাঁটটির মাজে বসাতে পারলাম। আমি ও আমার স্ত্রী দুই বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেনের মধ্যে দাড়িয়ে দীর্ঘ পথ চললাম।
মাকে নিয়ে গৌহাটি গিয়ে পড়লাম আরেক বিড়ম্বনায়, বড় মামা খবর পেয়েছেন যে, আমার ছোট মামা রাজাকার দ্বারা আহত হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে বালাট কেম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।আমাকে সপ্তাহ খানেক পর টাকা ও ঔষধ নিয়ে ছোট মামার কাছে যেতে হল। কি বিপদ সংকুল পথ যাত্রা । সর্বতই লোকজনের ঢেসা ঢেসি ও জীবন বাজী নিয়ে চলা।
প্রথম শিলিং গিয়ে আমার গোষ্ঠীর এক ভাতিজা উমাপদ ভট্টাচার্যের বাসায় উঠলাম।উনি সম্পর্কে ভাতিজা হলে আমার চেয়ে বয়সে বড়। উনাদের পরিবারটা বড়ই সম্মানীয় ছিলেন। উনারা ৫ ভাই ও উনাদের বউদের মধ্যেই ৪ জন শিলং সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন। যাক বালাট কেম্পে যেতে হলে পারমিশন নিতে হয় সেটা জোগাড় করলাম। কি বিভীষিকাময় সেই অধ্যায়। যতই যাত্রা পতে যাচ্ছি শরনারতিদের অবস্তা অবলোকন যেন এক মৃত্যুপুরী দেখছি। একটা নদী পাড় হয়ে যেতে হয় বালাট । নদীতে অগণিত লাশ দেখলাম। কলেরা রুগের প্রাদুরভাবে শরনারতিরা অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে। দু রাত থেকে মামার কাছ থেকে চলে এলাম আবার আমার ভাতিজার শিলঙের বাসায়। সর্ব মোট তিন দিনের পারমিশন ছিল। সবচেয়ে বড় কেম্প ছিল বালাট। আসামের এই কেম্পে ৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল।
শিলং এসে শুনলাম মুক্তিযুদ্বের তৎপরতা বাড়ানোর জন্য অপার থেকে বেগম মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও বর্তমান বাংলাদেশের মহামান্য রাস্টপতি আব্দুল হামিদ আসছেন। নেমে গেলাম সংগঠনের কাজে। তাদের জন্য করা প্রোগ্রাম ও সাংগঠনিক কার্যকর কমিটিতে অন্তরভুক্ত হয়ে কাজ শুরু করে দিলাম।আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এই তারিখটা কি আপনার মনে আছে ? সব আমার ডায়েরীতে লেখা আছে, ওটা যে বাড়িতে রেখে এসেছি। স্যার বললেন, সুরঞ্জিত আমার ক্লাস মেট এবং বেগম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃতে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি, একমাত্র অপরিচিত ছিলেন আব্দুল হামিদ সাহেব আমার কাছে।
মা ও পরিবারকে বৃদ্দ মামা-মামির কাছে একা রাখা ঠিক হবে না চিন্তা করে জুনের প্রথম সপ্তাহে ফিরে গেলাম গৌহাটি। এখানে এসে কলিকাতা যাবার পরিকল্পনা নিলাম। আমার স্ত্রীর বোনের বাসায় গেলাম, উনারা বরিশালের লোক। সেখানে আবার শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হলাম।কলিকাতায় দুমাস ছিলাম সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকলাম।
আবার ফিরে আসলাম মার কাছে গৌহাটি। আমরা জয় বাংলার মানুষের দিন পাত কঠিন থেকে কঠিনতর হতে শুরু হল। চাকুরী পাওয়া বড়ই দুস্পাপ্য। বউয়ের হাতের বালা বিক্রি দিয়ে শুর হল সংসারের ঘানি টানা। ভিটে মাটি ছাড়া কেমনে যে কি করি সেই ভাবনায় দিন রাত্রি যাচ্ছে।
এমনি যাতনার মধ্যে একদিন আমার মামার বাসায় এক মেহমান বেড়াতে আসার মাধ্যমে আমার ভাগ্যের সুপ্রসন্নতা গঠতে শুরু করল। উনি ছিলেন গৌহাটি হাইকোর্টের সিনিওর আইনজ্ঞ এম,কে, সেনের স্ত্রী।উনারা আবার মুলত আমাদের কুলাউরার লোক। ভদ্রমহিলা নিজে আবার অরবিন্ধ হাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। ভদ্র মহিলার কাছে আমার মামা আমার লেখাপড়ার খুবই ভূয়সী প্রশংসা শুরু করে দিলেন। তিনি বলতে শুরু করলেন আমার ভাগিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে মাস্টার্স ইত্যাদি। ভদ্র মহিলা এই সব শুনে খুবই খুশি, বললেন আমার কর্তা মুক্তি যুদ্বের কথা শুনতে অস্থির কালকে গাড়ি পাঠাব দয়া করে চলে আসবেন।আপনারা দু’জনের ভালো গল্প জমবে। মামা একটু অতি উৎসাহী ও খুশি হয়েই আমাকে সেখানে আগামীকাল যাবার কথা বললেন। যতারীতি গাড়ি পরের দিন চলে আসল। উনাদের বাসায় গেলাম। চা-নাস্তা সাড়ছি আর উকিল বাবুর মক্কেল গেলেই উনার সাথে গল্পে বসব এই অপেক্ষায় আছি। এই অবস্তায় মিসেস উকিল এক অনুরুধ করে বসলেন। উনার ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে কিন্ত ইতিহাসে কাচা। আমাকে ওকে খেয়াল নেবার দায়িত্ব নিতে বললেন। অতি সত্তর চলে আসল উনাদের পাশের বাসার শিখ দম্পতির বাচ্চাকে পড়ানোরও অনুরুধ। মাসের ১৫/১৬ দিন যেতে না যেতেই খাম হাতে চলে আসল। দুই বাসায় মিলে ২৭০ টাকা পেলাম।সেই সময় এই পরিমান আমার জন্য অনেক টাকা। আমি অনায়াসে তাই দিয়ে চলতে শুরু করলাম।আমার বেশ লোকদের সাথে সহমরতিতা হতে শুরু হল। তেমনি একটা পরিবার ছিল যা মুলত কুমিল্লা থেকে গিয়েছিল।উনারা নিঃসন্তান অত্যন্ত পরোপকারী দম্পতি। ভদ্রলোক একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে ভাল চাকুরী করেন। উনাদের দুধের গাভী ছিল। সকাল বেলার দুধ বিক্রি করে দিতেন এবং বিকেল বেলা দুধ দুয়াইয়ে আমারা সহ অন্য প্রতিবেশিকে দান করে দিতেন।
সময়ের প্রেক্ষিতে স্বাবলম্বী হতে শুরু করলাম। মামার বাসায় থাকা আর মানায় না। নিজে বাসা নিলাম ৭০ টাকা মাসিক ভাড়া সাবস্ত করে। বাসা মালিক বদান্যতা দেখিয়ে বললেন আপনি ৪০ টাকা মাসে দিলে চলবে। গৌহাটিতে প্রফেসর পাড়া বেশ নাম ডাক। সেখানেই বসবাস শুরু করলাম, পাড়ার পাশেই বউদি দের দোকান অর্থাৎ মহিলারা দোকান দিতেন। মেয়ে ছেলেদের ঐ বাজারে আনাগুনা ছিল বেশি। এক বউদির সাথে ভালো পরিচয় হল, উনার দোকান থেকে প্রায় সব বাজার সদাই নিতাম।
ভাগক্রমে আমার এক বন্ধু আগে থেকে সেথায় চাকুরীতে ছিল। সে আয্র বিদ্যাপিট কলেজে দিবাকালিন শিক্ষক। সে আমাকে রাতের শিক্ষকতা যুগিয়ে দিল ওর কলেজে। একি সাথে আরেকটা চাকুরী হল স্তানিয় বেসরকারি হাই স্কুলে। উভয় স্তানে ১ম জানুয়ারিতে যোগ দেবার চাকুরীর নিয়োগ পত্র পেলাম।
এই দিকে চোখ মন সব পড়ে আছে নিজের দেশের দিকে। কখন যে কি হয় অপেক্ষায় আছি। দেশ স্বাধীনের খবরটা আসে কিনা।আমার মনে বিশ্বাস দেশ স্বাধীন হতে চলছে, কিসের চাকুরী করব? দেশের জন্য মন উতালা হয়ে উঠতেছে। ঠিকিই সেই মধুর ক্ষণ উপস্থিত হল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মৌল্ভী বাজার মুক্ত হল পাঁক বাহিনীর হাত থেকে। সাথে সাথেই দেশের পথে যাত্রা শুরু করলাম।আর কিসের অপেক্ষা বা চাকুরী, ডিসেম্বর এর ৮ তারিখ ই বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করে ১০ই ডিসেম্বর গ্রামের বাড়িতে পৌছালাম। যাত্রাটা এমনি ছিল, ট্রেনে গৌহাটি থেকে বদর পুর হয়ে ধর্ম নগর। সেখান থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে কৈলাসর আসলাম। তারপর ট্রাক যোগে নিজের জন্ম ভিটায়। আমাদের গ্রাম, বাড়ি- ঘর পুড়া মাটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আশ পাশের মুসলিমরা সবার বাড়িতে নিয়ে আমাদের রাখার জন্য অস্তির হয়ে গেল। বিশেষ করে তখনাকার সরপঞ্চ, রাজা মিয়া ও মখলিছ মিয়ারা খুব টানা টানি করতেছিলেন। কিন্ত আমরা সিদ্বান্ত নিলাম মোটামোটি একটা আবরণ দিয়ে নিজ ভিটিতে থাকতে। আমাদের বর্গা চাষি ছরকুম উল্লা চাচা কিছু ধান চাল দিয়ে গেলেন। আমাদের একটা গাভী ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন দুধ খাবার জন্য। চরকুম উল্লা চাচা আমাদের জায়গা জমি বার বছর থেকে করে আসছিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনার মা বেঁচে যাওয়া এবং আপনার সাথে মিলন তো একটা অলৌকিক ব্যাপারের মত না? স্যার বললেন, শুধু আমার মা না, এটার জন্য আমাদের তিন গ্রামের মানুষকে স্মরণ করতে হবে মুসলিম লিগার মখলিসুর রহমান কে। উনি হলেন খালিশ পুর গ্রামের এবং মৌল্ভী বাজার ক্রিসেনট ফার্মেসির মালিক মসনুর আব্বা। যে দিন আমাদের গ্রাাম জ্বালান হয় তার আগের রাত্রে ফজরের আগে উনি বাড়িতে এসে ঢেকে ঢেকে সবাইকে নদী পাড় হয়ে তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যেতে বলেন। লোকজন উনার কথা শুনেছিল বলে প্রানে রক্ষা পেয়েছিল।
ভদ্রলোক এই কাজ করতে গিয়ে মরতে বসেছিলেন। আমি শুনেছি যেদিন আর্মি আমাদের গ্রামে আসে উনি স্থানীয় মুসলিম লীগার হিসাবে পাকিস্তানীদের বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে আমাদের গ্রামে কোন হিন্দু নেই। পাকিস্তানী আর্মি উনাকে বিশ্বাস করে চলে যাচ্ছিল কিন্ত আরেক জন উনার সম্বন্ধে বলে দিল যে উনি মিথ্যা বলেছেন। তখনি আর্মি উনার দিকে উদ্যত হতেই জানের ভয়ে দৌড়ে গিয়ে ডুব দিয়েছিলেন স্থানীয় তহশিল অফিসের খোলা পায়খানায়। পাকিস্তানী আর্মি কাছাকাছি এসেও ভাবতে পারে নাই যে কেউ ওখানে ডুব দিতে পারে তাই চলে গিয়েছিল। উনি যে ডুব দিয়ছিলেন সেটা দেখেছিল পিয়ন সমদ উল্লা। আর্মিরা যেতেই পিয়ন সবাইকে হাঁক ডাক দিয়ে এনে মখলিছুর রহমানকে তুলে পানি ঢেলে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। কাজির বাজার থেকে শাহ্ বন্দর পর্যন্ত কোন হিন্দু গ্রাম ওর বাকি রাখে নাই যে পুড়ায় নাই।
এই জন্য আমরাও উনার মূল্যায়ন করেছিলাম। উনি যখন চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাড়িয়ে ছিলেন আমরা সবাই এক হয়ে উনাকে ভোট দিয়ে পাশ করিয়েছিলাম। স্যার এর থেকে কি আমারা মুসলিম লীগার ও রাজাকার এর একটা ব্যবধান টানতে পারি ? আর যদি হয় তা কি হবে ?
স্যার বললেন,বেশির ভাগ মুসলমান মুসলিম লীগ করতেন ও ভালো লোক ছিলেন। সমীকরণটা তাহলে কি দাঁড়াল স্যার ? হিনদু জন গোষ্ঠী পাশ করাচ্ছে মুসলিম লীগারদের।
মানবতা নয় কি ? স্যার বললেন তাতো অবশ্যই। মানুষ মানুষের জন্য।
স্যার বলছেন আমরা যখন উনাকে একচিত্তে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি তাতে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য এবং এমন কি আমি যাতে উনাকে সাপোর্ট না করি সেই জন্য টেমা ঘোষ ও আজিজ ভাই আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আমি জিগ্যেস করে নিলাম এম, পি আজিজ সাহেব কি আপনার বয়সে বড় ? আপনি যে ভাই ডাকছেন। আমরা সম-বয়সী হলেও একে অন্যকে ভাই বলে সম্বোধন করে থাকি।
আমার যেন কেন মনে হতে লাগল আলাপ ও বিষয় আর দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। জুলাই ও অগাস্ট মাস মিলিয়ে স্যারকে বেশ কয়েক বার ফোন করে এই লেখার তথ্য উপাত্ত নেওয়া হয়েছে, পাছে যদি স্যার কোন ভাবে কষ্ট পান। উনার বয়সের দিকে আমর খেয়াল রাখতে হবে। তাই আজ ২০ শে সেপেটম্বর স্যারের সাথে চূড়ান্ত লেখটার পাঠ শুনিয়ে উনার সম্মতি নিয়ে শেষ করলাম।
নিম্নের বাক্য সম্ভার স্যারেকে স্মরনে রেখে শেষ রেখা টানলাম।
স্যার আমি বিমোহিত । একটা জীবনকে এমন ভাবে শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি দিয়ে মোড়িয়ে সমাজের কল্যাণে বিলিয়ে দেওয়া যায় শুনে। আপনার সাথে এই আত্মিক আলাপ না হলে হয়ত এক জীবনের এত গুলো সফল অধ্যায়ের জ্ঞানই পেতাম না।আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।জানিনা আমার এই অনুসন্দ্বিৎসু মন আপানাকেই খুজছিল কি না। আপনাকে জানা মানেই তো প্রকারন্তরে আমার এলাকাকে জেনে নেওয়া এবং জেনে নিলাম বটে। শুধুই কি এলাকা ? তার চেয়ে অনেক প্রসারিত হল রাস্ট, সেই তৎকালীন পাকিস্থান রাস্টীয় পর্যায়ের গুণী ব্যক্তিদের সম্বন্ধে জানলাম। তিন যুগের মানবকে আপনার সুবাধে জানতে পারলাম।আপনার সকাশে হে শিক্ষা গুরু আমার শ্রস্রদ্দ বিনয়তা রহিল। সবশেষে কামনা করি আপনার ও আপনার স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ হউক। কানাডার সুন্দরয্য মন্ডিত বোধ নিয়ে ফিরে যান আপনার জন্মভুমি মৌল্ভী বাজারের, বাসু দেবশ্রী গ্রামে। সচরাচরের মত মঙ্গলময় সুস্থ পথা চলা হউক দু’জনের। বাড়িতে, গ্রামে,দেশে হউক আবার আপনাদের শুভ ফিরতি যাত্রা। গাছের ছায়ায়, পাখির ডাকে, মনু নদীর শীতল সমীরণে হউক আপনার শরীর ও মনন সদা স্নাত। নিরজুম সময়ে সাক্ষী হউক মা- প্রকৃতি, সুরে ও ছন্দে, আনন্দের ঝর্ণাধারায়। এই কামানান্তেই টানছি সমাপ্তি এই বেলায়। ধন্যবাদ।
লেখকঃ মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান (এডভোকেট)
লন্ডন ২১/০৯/২০২০
আগের পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন https://mahlondon.com/2020/10/24/%e0%a6%ab%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9a%e0%a7%8b%e0%a6%96%e0%a7%87-%e0%a6%ab%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a7%87-%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%96-2/