ডেস্ক রিপোর্ট : বিলেতের মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের শত্রু হিসেবে বরাবরই আবির্ভূত হয়েছেন নিজ জন্মভূমির বাসিন্দারা। এই শত্রুতার কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখছে পরশ্রীকাতরতা আর ঈর্ষা। এর জেরে বিলেতের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেবল বিভাজনই বাড়ছে না বরং ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের উত্থানের প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠছে তা। গত চার দশকে ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের’ অসংখ্য উদাহরণ তৈরি হয়েছে।
২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর প্রথমবারের মতো লুৎফুর রহমান টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচিত হন। সিলেটে জন্ম নেয়া পেশায় আইনজীবী লুৎফুর ব্রিটেনের কোন বারার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম নির্বাহী মেয়র। লেবার পার্টির নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত টাওয়ার হ্যামলেটসে লুৎফুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ঐ নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হেলাল আব্বাস। তিনি পেয়েছিলেন মোট প্রদত্ত ভোটের মাত্র ২৪ শতাংশ বা ১১ হাজার ২৫৪টি। ২০১৪ সালের বৈরি পরিস্থিতিতেও লুৎফুর রহমান পুনর্নির্বাচিত হন।
দুইবারই লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে একাধিক ব্রিটিশ বাংলাদেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জামানত হারান। এরপরও তাকে আটকাতে না পেরে আনা হয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। আর সেই মামলা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী আজমল হোসেন। আদালতের রায়ে মেয়র লুৎফুর রহমান পদচ্যুত হন। সে সময় আদালত তাকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। মামলার খরচ যোগাতে লুৎফুর রহমানের লন্ডনের বসতবাড়িটি নিলামে বিক্রি হয়।
পরবর্তী গত দুটি নির্বাচনে এ বারায় মেয়র পদে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বংশেদ্ভূত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তারা কেউই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উঠে আসতে পারেননি। লুৎফুর রহমান পরে দীর্ঘ তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হন। টাওয়ার হ্যামলেটসের আসন্ন নির্বাচনে লুৎফুর রহমান প্রতিদ্বন্দিতা করবেন বলে জানা গেছে। লুৎফুর রহমানের হাত ধরে অন্তত ৩০ জন ব্রিটিশ বাংলাদেশি নারী পুরুষ কোনও ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এদের অনেককেই তিনি ডেপুটি মেয়রসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। কিন্তু তার দুঃসময়ে লেবার পার্টির এমপির মনোনয়ন পাওয়া অহিদ আহমদ ছাড়া কেউই পাশে থাকেননি।
আরেক উদাহরণ বিশ্বনাথের ভুরকি গ্রামের সন্তান রোশনারা আলী ২০১০ সালে প্রথমবার লেবার পার্টির মনোনয়নে বেথনাল গ্রিন ও বো আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ব্রিটেনের প্রথম ব্রিটিশ বাংলাদেশি আইনপ্রণেতা। গত তিনটি নির্বাচনেও তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। প্রথম দুটি নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও পরে ভোটের মাঠে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাংলাদেশি একাধিক ব্যাক্তি প্রার্থী হন।
বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ২০১৫ সালের নির্বাচনে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে প্রথমবার মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তার আসনটিতে খুব সামান্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভোটারদের বসবাস। বঙ্গবন্ধুর নাতনি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বোনের মেয়ে হওয়ার কারনে ২০১৫ ও ২০১৭ সালের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার অপরাজনীতির শিকার হন তিনি। যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতাকর্মীরা দলবল নিয়ে পূর্ব লন্ডন থেকে গিয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালান। তার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান তারা।
এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক ড. রেনু লুৎফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশিরা জাতিগতভাবে ভীষণ পরশ্রীকাতর, অন্যের সুখ দেখতে পারার যোগ্যতা এখনও অর্জন করতে পারেনি। কারণ অন্যের সুখ দেখে সুখ পাবার প্রথম সিড়ি হলো নিজে সুখী হওয়া।
আশি ও নব্বই দশকের দুটি সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন ও বো আসনে এমপি পদে লেবার পার্টির মনোনয়নের জন্য শর্টলিস্টেড ছিলেন চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী। তারা হলেন প্রয়াত জাহাঙ্গীর আলম, কাউন্সিলর রাজন উদ্দীন জালাল, পলা মঞ্জিলা উদ্দিন ও কুমার মুর্শিদ। দুবারই শর্টলিলিস্ট থেকে বাদ পড়েন প্রয়াত জাহাঙ্গীর আলম ও কাউন্সিলার রাজন উদ্দিন জালালকে।
ব্রিটেনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাজন উদ্দিন জালাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে মীরজাফরেরা আছেন। আশির দশকেই আমার ব্রিটেনে এমপি হবার কথা। তাদের জন্যই পারিনি। লুৎফুর রহমানকে ধ্বংস করতেও বাংলাদেশিদের কাজে লাগিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। বর্তমানে পপলার ও লাইমহাউসের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আপসানা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আপসানার বিরুদ্ধেও শুরু থেকেই বাংলাদেশিদের একটি অংশ সক্রিয়। বিলেতের রাজনীতিতে বাংলাদেশিরাই বাংলাদেশিদের উত্থানে সব সময় প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়িয়েছেন।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১০ সালে লেবার পার্টি আমাকে এমপির টিকেট দিয়েছিল। লেবার ফেন্ডস অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ছিলাম। তবু লুৎফুর রহমানের সাথে যখন অনায্য আচরষ হয়েছিল তখন সেই অনায্যতার প্রতিবাদে লেবার পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। গত ২০ বছর ধরে একসঙ্গে আছি।’
তবে অহিদ আহমদ স্বীকার করেন, সুসময়ে যারা লুৎফুর রহমানের পাশে ছিলেন, সিনিয়রদের প্রায় সবাই দুঃসময়ে তার পাশে থাকেননি।