মালনী ছড়া চা বাগানে আত্মীয় বাড়ীতে বেড়ানো মানে এক অবারিত আনন্দ সুখের আহবান।
আমরা তখন বসবাস করছি চন্দন টুলায়।বছরে বড় জোর ২/৪ বার মালনী ছড়া আপার বাসায় যাওয়া হত কি না সন্দেহ আছে। সেই সময়ে সিলেটের জীবনের প্রেক্ষাপটে তা অনেক দুরের পথ। যদি বিশেষ কোন দাওয়াত দেওয়া বা বিশেস সিন্নী সালাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত তখনই যাওয়ার হেতু হত। যদি বাড়ি থেকে বা বাহির জেলা থেকে বিশেষ মেহমান আসেন এবং উনাদের মনোরঞ্জন মূলক একটা বেড়ানো দেওয়ার প্রয়োজন হত, আমরা চলে যেতাম মালনী ছড়ার আপার বাসায়।
নতুবা উনারা উনাদের জীবন নিয়ে চলছেন, আমরা আমাদের। যেমন কাছের দুই আত্মীয়ের বসবাস দুই শহরে। আসলেই তো দুই শহরই ছিল সেই সময়ে। একটা ছিল সিলেট শহর ও আরেকটা ছিল সিলেট নামধারী পাড়া গাঁ। আম্বর খানা পর্যন্ত এক ধরনের জীবন চাল চিত্র।
দেখি একটু স্মৃতির জানালা দিয়ে ঘুরে আসতে পারি কিনা।—-
যতই আপনি রিক্সা নিয়ে আম্বরখানা ছেড়ে মজুমদারি, লেচু বাগান, খাস দবির, চৌকিদেখি পৌছোবেন স্থানে স্থানে জীবন বৈচিত্র্য পরিস্কার পরিলক্ষিত হবে। তবে তা লাক্কাতুরা টি গার্ডেনের গেইট পর্যন্ত। এর পড়ে এক অনন্য স্বাপ্নিক রূপসী জগত।
তখনকার সময়ে আম্বরখানা মাছ বাজার পাড় হলেই শহরের যা কোলাহল ছিল তা নিথর নিরব হয়ে যাবে। বাজার পারি দিয়েই হাতের ডানে জলাবদ্ধ অব্যবহার যোগ্য জমি, তার বামে নেপালীদের বিরাট বসত বাড়ি। যার সামনে বাঁধা আছে সাদা সাদা অনেক গুলি গাভী। আপনাকে জানান দিবে গ্রামের হাতছানি। তার পর যতই রিক্সা নিয়ে এগুবেন দেখবেন হয়ত মজুমদারি বা লেচু বাগানের মানুষ জন এখনও যার যার বাড়ীতে আছে আরাম আয়াশে দিব্যি। কোন জন গোস্টির সাড়াও পাওয়া যাবে না। পাকা রাস্তায় পাবেন না এমন কোন চিহ্ন যা জানান দিবে ওরা ব্যবসা বা অফিসে যাচ্ছে । এমন কি আম্বরখানা পুলিশ ফাড়ির সামনের যে ২/১ টা দোকান তার ঝাপি হয়ত তখনই হয়নি উত্তোলিত। তবে রিক্সা মেরামতের দোকানে দেখা যেতে পারে কিছু হালকা কর্ম চাঞ্চল্য। নিরঝুম পথ চলা, আপনার রিক্সাটা চলছেই চলছে। অনতিদূরে লেচু বাগানে ২/১ টি দোকান। আছে গুয়াই পারার জমির নাপিতের সেলুন। চলছেন তো চলছেন। খাসদবির পাড়ি দিয়ে দেখবেন ভাঙ্গা একটা দোকানের সামনে রাস্তায় এক ড্রাম রেখে দিয়েছে এক দোকানি। সে জানান দিচ্ছে এখানে ডিজেল বিক্রি করে। এই সব ছিল রাস্তার পাশের ব্যবসার পসরা। আর সাক্ষাত হবে দুইটা ঝুপড়ি সম দোকান মালনী ছড়া বাজারে।
তেমন একটা যানবাহন হবে না পরিলক্ষিতঃ-
দীর্ঘ বিরতি দিয়ে অপাশ থেকে যদি ২/১ টা রিক্সা আসে শুধু তাই। নেই আর কোন কোলাহল। যান বাহন বলতে ঘণ্টা বিরতিতে এক দুইটা বেবি টেক্সি। প্রাইভেট গাড়ি বলতে কিছুই আপনি দেখবেন না। লাইটেস মাইক্রোবাসের সহিত সাক্ষাত হয়নি সিলেট শহরের তখনও। তবে এই রাস্তার নিয়মিত আকাশী রঙ্গের বিমানের স্টাপ পরিবহনের কোচ চলাচল করত।
– আর যা একটা ছিল ৪২ মডেলের সালু টুকুরি বাস। সেটা হয়ত আম্বর খানা থেকে সেই সকালে ছেড়েছে । সালু টিকর বাজারে পৌছে দুপুরে আবার ফিরবে বলে আছে সেই অপেক্ষায়। এই সালু টিকরি বাস যথারীতি প্রতি বছর একবার মালনী ছড়া বাগানের রাস্তার মোড়ে চিতপটান দিত।
জীবনে ঐ সব বাসে উঠি নাই বা উঠার প্রশ্নই উঠে না। ঐ বাসের শতকার ১০০ ভাগ পেসেঞ্জার ছিল মাইমাল। যারা মাছ নিয়ে সকালে আসত ও বিকেলে বাড়ি ফিরত। বাসের উপরে থাকত মাছের চাঙ্গা ও ভিতরে শুধু ওদের চেঁচামেচি।
যাক, যখন খাসদবির ও চৌখিদেখির নীরবতা ভেঙ্গে রিক্সা অগ্রসর হবে তখনি একটা শীতল মায়াবি বাতাস আপনাকে আচ্ছদিত করে জানান দিবে যে আপনি লাক্কাতুরা চা বাগানের গেইটে। এখানে আসার সাথে সাথে বাগানের চমৎকার গেইটের সামনের পরিপাটি দৃশ্য আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য ভুবনে। বামে আপনার দৃষ্টি কেড়ে নিবে প্রকান্ড রেন্ট্রি গাছ ও তার পাশে বহমান স্বচ্ছ পানির ছড়া। একাবার ডানে চোখ নিয়েছেন তো একবার বামে। আপনি চলে যাবেন এক সৌম্য শান্তি ও ভালোবাসার আমোদ বিহারে।
ডানের কিছু ধানি প্রকৃতির জমি সুবোদ শান্ত হয়ে শুয়ে আছে আপনার নয়নকে দিতে প্রশান্তি। তার পাশে বিছানো আছে চা গাছের সবুজ বেষ্টনী। এই সবুজকে শান্তির সমীরণ দিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড ছায়া প্রদান কারি বৃক্ষরাজি। বায়ের পলকে কেড়ে নিতে পারে আপার মনোযোগ কোন এক চা শ্রমিক তন্বী। সে হয়ত এসেছে নিত্য ব্যবাহারী বাসন নিয়ে চড়ার কল কল স্পটিক জলে ধুইয়ে নিতে।
এর মধ্যে আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য এবং যখন ঠিকই হারিয়ে গেছেন তখন রিক্সা ড্রাইভার থামাবে রিক্সা মালনী ছড়া দোকান গুলির সামনে । হাতের বামে দৃশ্য হবে গল্প ক্লাবের উচু টিলা। রিক্সা ড্রাইভারকে বলতে হবে আরেকটু আগাও। আমি এসে নেমে যাব মালনী ছড়া বাগানের রাস্তার আগে পূর্ব মুখী বালু ময় রাস্তার মুখে।
তখন আমাদের কালচার ছিল রিক্সা ড্রাইভারদের অহেতুক কষ্ট না দেওয়া। বালুতে রিক্সা টানা বড় কস্টকর। তাই আমরা নেমে যেতাম মেইন রোডে।
মেইন রোড থেকে সুজা পূর্ব মুখী যে রাস্তা সে রাস্তায় ঠুকেই আমার আত্মীয়ের বাসা।
এই রাস্তার আশে পাশে ছিল আমার বেশ ঘনিস্টজনের বসবাস। রাস্তা সোজা চলে গেছে কিন্ত ওর দুই পাশে বিরাট মাঠ। মাঠকে মাঝে রেখে বাসা গুলি সাজানো। ঐ রাস্তার ডান পাশে ছিল বড় মন্ডপ যেখানে প্রতি বছর বেশ জমাট আসর হত । শহরের অনেক লোক আসত। ঐ মন্ডপের ঠিক দক্ষিন পূর্ব বাসাটা ছিল আমার শিক্ষিকার। দিদি আমাকে পড়িয়েছেন খাসদবির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আজও দিদির সেই হাই লেভেলের ক্লাসের কথা মনে পড়ে। ভুগোল ক্লাসে পুরাকীর্তি বুঝাতে গিয়ে দিদি আমাদের ক্লাসে নিয়ে এসেছিলেন একটা পুরাকীর্তির নিদর্শন। আমার সহপাঠি উত্তমের অবশ্যই মনে আছে সেই ক্লাসের কথা, আমি নিশ্চিত। সেও ঐ মালনী ছড়ার ছেলে । ওর বাসা ছিল রাস্তার উত্তর পাশের মাঠের ঠিক মাজামাজি। দুই মাঠ ছেড়ে আবার বামে ডানে রাস্তা। বামের রাস্তায় ডুকে আমাদের আত্মীয় পাপ্লুদের বাসা। তার পরের বাসাটা আবার আমার প্রান প্রিয় শিক্ষক মতিন স্যারের বাসা। উনিই আমাকে নিয়ে এইডেড স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়েছিলেন।
আর ঐ বাসা মানে পাপ্লুদের বাসা যার জন্য এত লেখার অবতারণা করলাম। এই বাসা বলতেই, মালনী ছড়া আপার বাসা। যার কথা স্মরণে আমার মননে চলে আসে অনেক সুখময় স্মৃতি। বছরে একবার আপার বাসায় গিয়ে থাকা। আপার হাতের মায়া ময় সুস্বাদু খাবার ও মায়াবী কথন এখন প্রানে সুখের আলোড়ন জাগায়। ভাগনা ভাগ্নিদের সম্মান ও আদর যেন এক মায়ময় সপ্নপুরী। আমার বয়সে বড় ছিল আমার দুই ভাগ্নি শেলি ও নিলু। আমি ওদের বাসায় গেলে আপা চাইতেন ওরা এসে আমার পায়ে ধরে সালাম করুক। কিন্ত আমি তো মরি লজ্জায়। যাক এটা কোনভাবে প্রতিহত হল। পারভিন, রিপন, পলি, ও কলি মনির তো মামা আসলেই পায়ে ধরে সালাম করতে হবে। কী সুন্দর সভ্যতা ভব্যতা নিয়ে ওড়না কন্যাদের মত মাথায় বড় করে টেনে ওরা সালাম করত। সালাম করে যে যেত আর মামাদের দেখা নেই।
আমি, ভাগনা পাপলু ওর চাচাত ভাই ভাগনা মিন্টু এক সাথে বসে আলাপ করা। নামাজের সময় কলের পাড়ে গিয়ে ওযু করে এসে জামাতে নামাজ পড়ার কী সুন্দর পরিবেশ ছিল সেথায়।
আমি হয়ত পরিশ্রান্ত নয় তারপরও আপা আমার মুখ দেখে বলবেন আমার ভাইটা রোদে জ্বলে এসেছে ওকে তাড়াতাড়ি লেবুর শরবত দাও। আর সেই সরবতের স্বাদ ও মান আর পৃথিবীর কোথায়ও পাবার নয়। খাবার সময় না হলে আসবে নাস্তা। একটু পর বাড়ি ময় যে সৌরভ ছড়িয়ে পরবে তার তুলনা পৃথিবী ব্যাপী হয় না। এই যে এখনই সেই সুবাসিত গন্ধ নাকে লাগছে। সেটা আর কিছু না ঐ পূর্ব ভিটেয় পাকঘরে চা জ্বাল দেওয়া হচ্ছে আর এই পশ্চিম ভিটের সর্ব পশ্চিমের রুমে চায়ের গন্ধের স্বাদে মন হিল্লোলে দুলছে। এরপর বড় চেপ্টা একটা পেয়ালায় যখন চা আসতে লাগে তখন আমার লোভাতুর চোখ কাপকে চাখতে থাকে। চায়ের কাপ থেকে চোখ সড়বে না এক সেকেন্ডের জন্য। চাতে চুমুক দিব পেয়ালার দিকে থাকাব আবার চুমুক দিব কথা বলব, আবার চুমুক দিব। সেই যে চায়ের প্রতি আসক্তি গঠেছিল এখনও আছে। যদিও প্রতি দিন বিরামহীন ভাবে দিনে রাতে যে কোন সময় এমন কি ঘুমাতে যাবার আগে চা পান চলছে, কিন্ত যেই স্বাদ খুজি সেটা লন্ডনের পি.জি টিপে পাই না। আমার চায়ের প্রতি নেশার জন্য মালনী ছড়া দায়ী- ঐ সম্বোদনী চায়ের গন্ধ আজও খুজি।
কি সুন্দর ছিল মালনী ছড়া আপার বাংলা বাড়িটি। সুপেয় পানির জন্য টিউব অয়েল ও ইন্দারা ছিল। ছিল দুধের গাভী। আপাদের সিন্দি গাভীটা তো আমরা কিনেছিলাম। অনেক দিন দুধ খেয়েছি। শেষমেশ ঐ গাভীটাকে আমার খালার বাড়ী গুরারাই পাঠিয়েছিলাম মানুষ দিয়ে হাটিয়ে। গাভীটা ঐ পরিবেশে মানাতে পারে নাই, তাই খুবই দ্রুত হয়ে পড়েছিল রুগ্ন।
তখনকার সময় ঐ দিকে অর্থাৎ মালনী চড়ায় যেই আসত ঐ সব অঞ্চলের লোকরা জানত কার বাসার মেহমান কে। আমি ও ভাগনা মসুদ একবার ৫০ সি.সি মটর সাইকেল নিয়ে মালনী ছড়া বেড়িয়ে আসার পথে চৌখিদেখি বালুকাময় রাস্তায় পড়ে হালকা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বাসায় চলে আসি। কিন্ত ঠিকই মালিক ভাইসাব ( পাপ্লুর আব্বা ) খবর পেয়ে গেছেন যে উনার বাসার মেহমান কালকে রাস্তায় মটর সাইকেল নিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল।
এই ছিল তখন কার জীবন যাত্রা। মানুষ জন কম ছিলেন একে অন্যকে চিনতেন। একে অপরের প্রতি সদয় দৃস্টি রাখতেন। এত আধুনিকতা ছিল না। ছিল না অর্থ কড়ির চাকচিক্য, কিন্ত ছিল মায়া মমতা প্রেম ভালোবাস ও সৌন্দর্যের শান্তি ময় পরিবেশ।
আমি তো আমার স্ত্রীর সাথে প্রথম বৈঠকে তুলে ধরেছিলাম, মালনী ছড়া আপার সুখ সংসারের কথা। এই মালনী ছড়া আমাকে এমন ভাবে করেছিল সত্যিই বিমোহিত।
আমি বলেছিলাম ও বুঝেছিলাম উনার সংসার দেখে যে, টাকা পয়সা , ধন দৌলত এক জিনিস ও সংসার সাজানো ও তার সুখ অন্য জিনিস। এই মালনী ছড়া আমার এক আদর্শ। —- এখানেই এই ভাব রেখে সমাপ্তি টানতে চাচ্ছি, ধন্যবাদ।