ভ্রমন কাহিনী=========( ২য় পর্ব )
” চোখের জলে হেমন্তের বিদায়”—–
ইমিগ্রেশন শেষ করে একশ গজের ভিতরে কাস্টমস অর্থাৎ মালা মাল বা বডি চেক, মানুষদেরকে লজ্জাজনক ভাবে তল্লাশী করা হচ্ছে। তবে কিছু চেয়ারা ছবি দেখে কিছু কিছু মানুষ মান সম্মান নিয়ে যেতে পারতেছে। কাস্টম অফিসাররা বেগ হাতিয়ে দেখছে কাপড় চোপর ও টাকা পয়সা । তখন যতদুর মনে পড়ে ২০০ শত টাকার মত বাংলাদেশী টাকা সাথে করে নেওয়া যেত, ওপারে ভাঙিয়ে যাতায়ত খরচ করে বন গাঁ স্টেশনে যাবার জন্য বা অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচ পাতি মিটাবার জন্য। কাস্টম শেষ করে কয়েক কদম দিয়েই বেরিকেট পাড় হয়েই ইন্ডিয়া। যবে বেরিকেটের দিকে যাব তখনই পিছন থেকে এক সিলেটি ভাই ডাক দিয়ে বললেন, ভাই আমার সব টাকা অফিসার রেখে দিয়েছে। আর সামনে অগ্রসর না হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনার কাছে ছিল কি পরিমান টাকা ? উনি বললেন ১৬০ টাকার মত। আমি বললাম আপনি তো ২০০ টাকা পর্যন্ত আইনগত ভাবে নিয়ে আসতে পারেন। লোকটার অসহায় চেহারা দেখে দুঃখ লেগে গেল। ভুলে গেলাম আমি বিদেশ যাচ্ছি, সাথে সাথে বিদ্যুৎ গতিতে ঐ লোককে নিয়ে অফিসারের টেবিলে এসে অফিসারের চেহারা সুরত দেখে চমকিয়ে উঠলাম। একেবারে ফেরস্তা সুলভ একটা চেহারা, কাস্টমের সাদা পোশাকের সাথে লম্বা মুষ্টিবদ্ধ দাড়ি, ঐ চোরটাকে খুবই মানিয়েছে।ওর এমন চেহারায় এই হীন কাজ আমার রক্তে কি এক উন্মাদনা সৃষ্টি হল। কি থেকে কি হয়ে গেল যেন মহারাজা হয়ে গেলাম। বজ্র সম হুঙ্কার দিয়ে শুধু বলেছিলাম ” উনার টাকা এক্ষনি বার করেন”।লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নিচু করে ড্রয়ার থেকে চুপ চাপ টাকা গুলি বের করে দিল। ফিরে আসছি বেরিকেটের দিকে আরেক ভাই বললেন উনি আজমির শরিফ যাচ্ছেন উনারও কিছু টাকা রেখে দিয়েছে ঐ হারামি পাপিষ্ঠের দল। আমি উনাকে কিছু টাকা দিলাম। উনি ঠিকানা চাইলেন, আমি বললাম ঐ গুলি আর ফেরত দিতে হবে না।
বেরিকেট পাড় হয়েই মানি একচেঞ্জের বেশ কয়েকটি দোকান । একটা দোকানে গিয়ে ২০০ টাকা ভাঙিয়ে ১২৩/১২৫ ইন্ডিয়ান টাকা পেয়েছিলাম যতদুর মনে পড়ে। এই পাড়ে এই ব্যবস্তা থাকলে কিন্ত আমাদের বাংলা দেশের পাড়ে মানি চেঞ্জের কোন ব্যবস্তা ছিল না।
রিক্সায় চাপলাম বন গাঁ রেল স্টেশনে যেতে। সেখান থেকে শিয়াল দাহ স্টেশন, কলি কাতা। রাস্তায় কিছু যেতে না যেতেই মাস্তান পুলা পাইন রিক্সা আঠকিয়ে সামনে দুর্গা পুজার চাদা চাচ্ছে। আমরা দিতে অস্বীকার করায় শুনিয়ে দিল, ”কেন মশাই দিবেন না ? ঢাকাতে গেলে ইদের জন্য জুরে টাকা নিয়ে যান” । আমরা বললাম আমদের কাছ থেকে ঐ সব হবে না, দিব না। কিছু ঝারি ঝুরি মেরে আবার রিক্সাটাকে ধাক্কা দিয়ে ওরা চালিয়ে দেয়। আরেকটা নতুন কালচারের সহিত পরিচিত হলাম, রিক্সা মধ্য পথে এসে আর ঐ দিকে যাবে না। সে আমদের নামিয়ে দিয়ে অন্য একটা রিক্সায় উঠতে বলল। আমরা বললাম ভাড়া ধার্য হল বন গাঁ পর্যন্ত এখানে নামব কেন? রিক্সা ড্রাইভার আমাদের কে বলল আপনাদের আর কোন টাকা দিতে হবে না, যা বলেছিলাম সেটাই। এই রিক্সা ড্রাইভার আপনাদের নামিয়ে দিবে। এখন শুধু বাড়াটা দিয়ে দেন। বাড়া দিলাম দেখলান ওদের মধ্যে ভাগাভাগি করল। পরে বুঝতে পারলাম ওরা এই ভাবেই ক্ষেপ এর মাধ্যমে এই রাস্তায় রিক্সা চালায়। যাক স্টেশনে আসতেই আরেক জামেলা, যুবকরা এসে চাপা চাপি করতেছে আমরা যেন ওদের কাছে ডলার ভাঙ্গাই। আমরা বললাম আমাদের কাছে ডলার নেই। যাক ঐ যে চিঠিটা ঢাকায় আমাদের সাথে দেওয়া হয়েছিল তা নির্দিষ্ট দোকানে দিয়ে এসে স্টেশনে গেলাম । সেই চির চায়িত স্টেশনের চেহারা কিন্ত সাথে একটা জিনিষ নজর কাড়ল রেল লাইনের উপরে বিদ্যুতের তার। হাঁ তখন কলিকাতায় রেল চলছে বিদ্যুতের মাধ্যমে। আমার মনে হয় এখন পর্যন্ত আমাদের বাংলাদেশে এই ব্যবস্তা চালু হয় নাই। সেই আগের আমলের মত সেই পুরুন শক্ত কাগজের টুক্রু টিকেট কিনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতেছি। স্টেশন এর পাশে অভার ব্রিজে একটু গিয়ে দাঁড়ালাম। এমন অভার ব্রিজ আমার দেশে কোন স্টেশনে আমার তখন দেখা হয় নাই। ফলের দোকানে গিয়ে আপেলের কেজি জিজ্ঞেস করতে বলল ৮ টাকা , তখন আমাদের দেশে ৪০ টাকার কম ছিল না বলে মনে হচ্ছে। এক কেজি আপেল চাইলাম । কাগজের ব্যাগে এক একটা চার টুক্রু করে কেটে দিল। বেশ সুস্বাদই ছিল বলতে হয়। ট্রেনের সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। মোটামুটি ঠিক সময়েই চলে আসল। বেশী দূরের পথ ছিল না, দুই ঘণ্টার কম সময়েই চলে আসলাম শিয়াল দাহ স্টেশন। ট্রেনে ঐ বাংলাদেশে এর মত নয় ছয় অবস্তা। দাড়িয়ে গাজা গাজি করে যাত্রা এমনই। তবে তাদের ট্রেন গুলি বেশ পুরান আমলের আমাদের চেয়ে কিছুটা প্রসস্ত এবং মাজে বেশ হাতল ছিল মানুষ দাঁড়াবার জন্য। আরেক টা জিনিষ খুবই লক্ষনীয় যে, প্রতিটি স্টেশনের নাম তিন ভাষায় লেখা ।
ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা এবং প্রতেকটি সাইন বোর্ডের বাংলা রেখে অন্য দুই ভাষা কালো কালি দিয়ে মেখে দেওয়া হয়েছে। শিয়ালদাহ স্টেশনে পৌছে প্লাটফর্ম ছাড়তে পারি নি, পুলিশ যে কেমনে আমদের চিনল ? এসেই সোজা বলল আপনারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আমাদের সাথে আসেন। আসলে ওরা আমাদের পোশাক চেহারা দিয়েই চিনতে পারত। ওদের লোকরা ছিল আমাদের চেয়ে চেহারায় ভুসনে বেশ লক্ষণীয় ধরনের প্রাথক্য সম্বলিত।ইহা বিশেষ করে আমার একান্ত ধারনা। আমরা বললাম আমারা ভিসা নিয়ে এসেছি, পাসপোর্ট দেখতে চাইলে দেখেন , আপনাদের সাথে যাব না। তখন জিজ্ঞেস করল পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে এসেছেন? বললাম হাঁ। তার পর আর কিছু বলল না। আমরা হেঁটে স্টেশনের বাহিরে এসে হোটেল খুজব। পুলিশ খুজছিলাম জিজ্ঞেস করবার জন্য , একমাত্র দেখলাম হাফ পেন্ট পড়া ট্রাফিক পুলিশ হাত নাড়িয়ে কসরত করছে। লোকে লোকারন্ন একটা অশান্ত পরিবেশের হাতছানি, অগোচাল চলা ফেরা লক্ষণীয় । ঐ ট্রাফিক পুলিশ আমাদের কে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল ঐ যে উড়াল সেতু দেখছেন এর ঐ পাড়ে পাবেন হোটেল। উড়াল সেতুর নিচে আসতে ঢাকার গুলাস্তান ফেইল, মানুষের উপর মানুষ উঠে পড়ছে আর বিশেষ করে খুব বেশী মেয়ে ছেলে আপনার গায়ে লেগে চলে যাচ্ছে তার কোন তোয়াক্কাই নেই। দ্রত আশান্তি নিয়ে যেন প্রতিটা মানব সন্তান ছুটছে। কোন ভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করে বড় রাস্তায় গিয়ে একটা হোটেলের কাউন্টানে প্রায় আধা ঘণ্টা দাড়িয়ে ফেরত আসলাম। তেমনি ঘটনা ঘটল পরের হোটেলে। ভেবা চেকা খেয়ে গেলাম এই কোন দুনিয়ায় আসলাম। হোটেল আছে, কাউন্টার আছে, বর্ডার রিসিভ করার কেউ নেই। একটু হেঁটেই পেলাম এক পরিত্যক্ত বাড়ি সম এক হোটেল ! যাক একটা লোক মাটির মধ্যে বসে আছে। আমরা এগুতেই বলল রুম লাগবে ? আমরা বললাম আপনার ম্যানেজার কোথায়? আমরা ধরে নিয়েছিলাম সেই হবে ঐ হোটেলের কাজের লোক। সেই বলল আমিই ম্যনাজার। যাক বাবা বাঁচা গেল ! হোটেল খুজাচ্ছিলাম এখানে দেখি ম্যনেজার সাহেব নিজেই মাটিতে হাটু খুজু করে বসে বর্ডারের জন্য অপেক্ষয় মান। কোন চয়েস নেই। যাত্রার ক্লান্তি ও পেট চু চু করতেছে ক্ষিধায়। অন্ধকার একটা রুমে গিয়ে ঢুকলাম। কাপর চেঞ্জ করে একটু হাত মুখ ধৌত করব, ঐ লোকটাকে বলতেই বলল, আচ্ছা মশাই জল চাচ্ছেন ? ঐ যে ঐ রুমে পবিত্র গঙ্গা জল আছে স্নান সেড়ে নেন। গামছা লুঙ্গি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে কোথায়ও পানি দেখতেছি না। বের হয়ে বললাম জল কোথায় গোসল করব? কেন মশাই ওটাতো পবিত্র গঙ্গা জল। আমি মনে মনে বললাম তোর পবিত্র গঙ্গা জলের গোস্টি কিলাই। পেশাবের রঙ্গয়ের চেয়ে আর ধুসর হলুদ, আমি হাত দিয়েই চুইব না। গোসল তো দুরের কথা। আমি জিজ্ঞেস করলাম আর কোন জলের ব্যবস্তা আছে? সে আমাকে আঙ্গিনায় একটা ভাঙ্গা পাইপ দেখিয়ে বলল কাল সকালে ঐ পাইপ দিয়ে জল পড়বে। আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে এই কোন জগতে আসলাম ?
পরের সকালের অপেক্ষায় থেকে আমরা দুই জন বের হলাম একটা কিছু খাব বলে । বের হয়েই স্নেক্স বার পেলাম। হালকা খাবার খেয়ে পানি চাইলাম ।না পানি না, আসলে জলই চেয়েছিলাম। কাউন্টারের উপরে একটা বড় চায়ের কেতলি দেখিয়ে দিচ্ছে যা রশি দিয়ে বাঁধা। বুজে উঠতে না উঠতেই দেখলাম দুই একজন হাত বাড়িয়ে কেতলি তুলা দিয়ে নল দিয়ে গড় গড়িয়ে জল গলায় ঢালছে। আমাদে দেশে পান-সিগারেটের দোকানে যেমন মানুষ এক শলা সিগারেট কিনে ঐ ঝুলন্ত লাইটারে আগুন ধরায় তেমনি এখানে পানি খাওয়ার ব্যবস্তা। যেহেতু এই পরিবেশে অবস্ত নয় তাই পানি খাওয়া হল না। পাশের এক দোকান থেকে ড্রিনক কিনালাম।ড্রিঙ্কা ছিল খুব বাজে মানের শুধু ঘন মিস্টি পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
রাস্তা দিয়ে হোটেল এ ফিরে আসছি কানে আওয়াজ আসল ” অলি গলি মে শুর হে রাজিব গান্ধী চোর হে–” । হোটেলে এসে জানতে পারলাম আগামী তিন দিন ” বন্ধ” ওরা হরতাল বা ধর্মঘট বলে না বা শুনি নাই। শধুই শুনছিলাম বন্ধ। আমাদের মাথায় বারি পড়ল সাথে আমেরিকান এক্সপ্রেস ট্রেভেলার চেক না ভাঙ্গাতে পারলে চলব কিভাবে। আমাদের চিন্তা কাল সকালে হোটেল চেঞ্জ করব বুকিং দিব কিভাবে ? আমরা এমন চিন্তা করতে করতে ঐ বদ্ধ আধো অন্ধকার রুমে নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলাম। কলিকাতায় প্রথম রাত কি সপ্নে দেখেছিলাম বা কি দেখে নি মনে পড়ে না। তবে সপ্নকে বলেছিলাম আর কখন কলিকাতা আসার সপ্ন দেখবি না। মোটামুটি এটাই ছিল প্রথম ধারনা।যাত্রার ধুলা বালিতে চোখ মুখ আঠালো হয়ে গেছে। সকালে দেখা পেলাম সেই আরাধ্য পানির । একটু ঝিরি ঝির করে ভগ্ন পাইপ দিয়ে উনি ঝড়ছেন। একটা মগ চেয়ে নিয়ে কাকের মত মাথা ও শরীরটা ভিজালাম।
সকালে আবার সেই নাস্তার চিন্তা আসতেই কেতলির কথা মনে পড়ে গেল। আমি ভাবতে লাগালাম আরেকটু অগ্রসর হলে হয়ত অন্য ভাল মানের হোটেল পাওয়া যাবে। একটু দূর যেতে না যেতেই দেখলাম হোটেলের সারি। কিন্ত মানুষ জন ঠিকই খাচ্ছে তবে ভিতরে ও বাহিরে। বাহিরের লোকের মাটিতে আসন পাতিয়ে পাতার মধ্যে খাবার খাওয়া দেখে আর ঐ দিকে অগ্রসর হতে রুচিতে বাঁধল। পাতার মধ্যে খাওয়া ! এর পাশেই দেখালাম আর এক অদ্ভুদ ঘৃণিত কলিকাতার স্বভাব। মানুষজন নিজের বিদঘুটে হলুদ ও মিশ্র বর্ণের জিহবা বের করে এক ধরনের প্লাস্টিকের টুক্রু দিয়ে ঘসে ঘসে পরিস্কার করছে। আর গলা ও মুখের সংমিশ্রণে এক বিরক্তিকর ঘৃণিত শব্দের সুর তুলছে।
প্রচণ্ড এক ঘৃণা ও বিরক্তি নিয়ে ঐ পাশ থেকে দ্রুত স্তান পরিত্যাগ করলাম।
আর ঐ দিকে না এগিয়ে সেই আগের স্নেক্স বারের দোকান থেকে কিছু কিনে সেই আগের মত ড্রিঙ্ক কিনে উদর পূর্তি করলাম। হোটেল ফিরতি পথে পেপার কিনে নিয়ে আনলাম। পেপারের প্রথম পাতায় বড় করে লিখা ছিল ” চোখের জলে হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের বিদায়”। উনি বাংলাদেশ থেকে ঐ সময় অনুষ্ঠান করে এসেই অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যান। আমার কাছে ঐ পেপারটা এখনও আছে। সবচেয়ে বেশী চিন্তায় পড়ে গেলাম টাকা ভাঙ্গান নিয়ে। আমার সাথী ভাইকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সে বলল ভাই চলেন কোন ভাবে এয়ারপোর্ট যাওয়া যায় কিনা। এয়ার পোর্টের ভিতরে মানি একচেঞ্জ খোলা থাকবে। আমি খুবই খুশী হলাম আগে মুরব্বিদের কাছ থেকে শুনেছি লন্ডন থেকে বাড়ি ফিরতে দম দম এয়ারপোর্ট অনেকক্ষন বিরতি নিয়ে দেশে আসতেন, তাই সেই এয়ারপোর্টটাও দেখা হয়ে যাবে।—- ( চলবে )
(ছবি কফি হাতে, টাইগার হিল, দারজিলিং, ভারত, ১৯৮৯ ইং)