যেকোনো সম্পর্কের জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু চীন-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্ণ হলেও কখনোই তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন যে সার্বিক পরিস্থিতি, তাতে অদূর ভবিষ্যতে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখেন না পর্যবেক্ষকেরা। যদিও এশিয়ার এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটের ওপর মন্দ নয়।
এ লেখায় ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের দিকগুলো তুলে ধরব।
ভারতকে বলা হয় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এশিয়া মহাদেশের বিবেচনায় তাদের সামরিক বাহিনীও যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু চীনের সঙ্গে তুলনা করতে বসলে ছবিটা একটু অন্য রকম দেখায়। ১৯৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে অর্থনীতির আয়তন এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল ভারত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চীন যতটা এগিয়েছে, ভারত ততটা পারেনি। এখন চীনের অর্থনীতির আয়তন ভারতের পাঁচ গুণ, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তাদের ব্যয় ভারতের চার গুণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ভারত মহাসাগরে নৌশক্তিতে অনেক এগিয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেইজিংয়ের অবস্থানকে সুসংহত করেছে।
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে এশিয়া এবং পরে গোটা বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে সি চিন পিংয়ের চীন অনেক বেশি আগ্রাসী, দৃঢ়সংকল্প।
ভারত ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের আলোচনায় গেলে সবার আগে আসবে সীমান্ত সমস্যা। ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) সুনির্দিষ্ট চেহারা আজও দিতে পারেনি দেশ দুটি। এলএসি নিয়ে দুই দেশের চিন্তায় বিস্তর পার্থক্যও রয়েছে।
সীমান্তে উত্তেজনার পথ ধরেই ২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলাম মালভূমিতে ভারত ও চীনা সেনার সংঘর্ষ হয়।
২০২০ সালের ১৫ জুন ভারত-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের একটি সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতাহাতি যুদ্ধে ২০ ভারতীয় জওয়ান প্রাণ হারান। চীনের তরফে মাত্র একজন সেনার প্রাণহানির কথা কবুল করা হয়। শুধু গালওয়ান নয়, অচলাবস্থা তৈরি হয় লাদাখের গালওয়ান, প্যাংগং লেকের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত, গোগরা, ডেপস্যাং, হটস্প্রিং—মোট ছয়টি এলাকায়। পূর্ব লাদাখের গোটা ঘটনা ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দুটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে তলানিতে নামিয়ে আনে। আর জোরালো হয়ে ওঠে ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ। ডাক ওঠে চীনা পণ্য বর্জনের। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের উসকানি, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্কশ চিৎকার পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।
গালওয়ান উপত্যকার ঘটনায় চীনের মূলত উদ্বেগ ছিল ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কা নিয়ে, অন্য কোনো বিষয়ে না। ভারত ওই সময় বেশ কিছু চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। প্রসঙ্গত, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলি সংস্থা বিএসএনএল এবং এমটিএনএল বিপুল পরিমাণ চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। বিএসএনএলে দুই চীনা সংস্থা জেডটিই ও হুয়েইয়ের যন্ত্রাংশের অংশীদারি যথাক্রমে ৪৪ এবং ৯ শতাংশ। রিলায়েন্স, আইডিয়াসহ বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা সংস্থাও চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের দিকে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় ভারতে ‘জাতীয়তাবাদের বিস্তার’ ও রাজনৈতিক সরকারের ‘শক্ত অবস্থানের’ প্রেক্ষাপটে চীনের তরফে বিকল্প বাজার খোঁজার বিষয়েও আলোচনা হয়েছিল।
তবে সবকিছুই কি ছিল অভিনয়! সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালেই যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে আবার ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে উঠে আসে চীন। সীমান্ত বিরোধ পাশে ঠেলে রেখে চীনের সঙ্গে প্রায় ৭ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন হয় ভারতের, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। মুখে যতই চাপান-উতোর থাকুক, ঘুড়ির মাঞ্জা থেকে দীপাবলির আলো, সবকিছুর জন্যই ভারতের সহায় প্রতিবেশী চীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই দেশের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শিগগিরই মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
১৯৬০–এর দশকের শুরুতে তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও ‘আকসাই চীন’কে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবি করে চীন। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে চীন জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ভারতকে ফিরিয়ে দেয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ভারতকে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে সচেষ্ট হয়।