চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তে আত্মহত্যার প্ররোচনায় মোরশেদের ফুফাত ভাইসহ পাঁচজনকে আসামি করেছিল তার স্ত্রী। তবে পিবিআইয়ের দীর্ঘ তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে মোরশেদকে আত্মহত্যার প্ররোচনার কোন প্রমাণ মেলেনি। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আবেদনও করেছে পিবিআই। চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি রবিবার (৩ এপ্রিল) নিউজনাউকে নিশ্চিত করেছেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের প্রধান এসপি নাইমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্ত শেষে সবকিছু পর্যালোচনা করে এই আত্মহত্যায় কারো প্ররোচনার প্রমাণ পায়নি। ২০১০-১১ সাল থেকেই তিনি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। এটা একটি আত্মহত্যার ঘটনা। সেকারণে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন করেছি। এখন আদালত তা গ্রহণ করবে না পুনঃতদন্তের আদেশ দিবেন সেটা আদালতের এখতিয়ার। তিনি আরো বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা অনেকগুলো ব্যাংকের দায়িত্বে ছিলেন, ২০১০-১১ সাল থেকে তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। এতোগুলোর টাকার ঋণের কারণ তার পরিবার হয়তো জানবেন। গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক কামরুল ইসলাম। আদালত তা গ্রহণ করে আগামী ১৭ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন ধার্য্য করেছেন বলে জানিয়েছেন পাঁচলাইশ থানার জিআরও এসআই শাহীন ভূঁইয়া। ২০২১ সালে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা মামলা তদন্ত করছিল পিবিআই। মোরশেদের স্ত্রী ও মামলার বাদীর দাবি ছিল— তার স্বামীর ফুফাতো ভাইসহ কয়েকজন থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন তার স্বামী; সেই টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করলেও টাকার জন্য চাপ দেয়ায় সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছিলেন স্বামী মোরশেদ। এঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনায় মোরশেদের ফুফাত ভাইসহ পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান।
সেই মামলাটি প্রথমে পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক কবিরুল ইসলাম, ডিবিতে পরিদর্শক মইনুর রহমানের হাত ঘুরে পরে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক কামরুল ইসলাম তদন্ত করেন। পিবিআই ১০ মাসের তদন্ত শেষে জানালো— ‘মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্ররোচনায় আসামিদের বিরুদ্ধে কোন তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। তার সুসাইডাল নোটও সঠিক, মূলত অল্প সময়ে ধনী হওয়ার লোভেই নানা জন থেকে ধার দেনা করে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন এ ব্যাংক কর্মকর্তা। সেকারণে তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেন। মোরশেদের স্ত্রীর করা মামলায় পাঁচ আসমির বিরুদ্ধে প্রথম তিনজনের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের চাপে আত্মহত্যার প্ররোচনার কোন প্রমাণ মেলেনি পিবিআই’র তদন্তে। সেকারণে সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের আবেদন করে পিবিআই।’ আদালতে জমা দেওয়ার একটি অংশে পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘ভিকটিম আবদুল মোর্শেদ চৌধুরী ব্যক্তি জীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি অল্প সময়ে প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ব্যাংকে চাকরি করা কালীন খুব দ্রুততম সময়ে দায়িত্বশীল পদে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভিকটিম অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হন। ভিকটিম কথাবার্তায় ছিলেন যথেষ্ট চৌকষ। মানুষকে কথাবার্তা দ্বারা সন্তুষ্ট করার মতো গুণের অধিকারী ছিলেন। ভিকটিম অল্প সময়ে চাকরি জীবনে সফলতা লাভ করায় তার ছোট ফুফাতো ভাই, মামাতো ভাইদের কাছেও তার গ্রহণ যোগ্যতা ছিল এবং তারা তাকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতেন।’ ‘ভিকটিম প্রথমে তার বড় ফুফুর ছেলে পারভেজ ইকবালকে জানান, তার খাতুনগঞ্জে ব্যবসা আছে। মাঝে মধ্যে তার অল্প সময় (২/৩ মাস) এর জন্য টাকার প্রয়োজন হয়। পারভেজ ইকবাল যদি তার বাসায় টাকা বিনিয়োগ করে তাহলে অল্প সময়ে ভালো মুনাফা পাবে। ভিকটিম আসামি পারভেজ ইকবালকে বলেন, ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে খুব বেশি লাভ পাবে না, তাকে (ভিকটিম) অল্প সময়ের জন্য (২/৩ মাস) টাকা দিলে তিনি (ভিকটিম) তাকে প্রতি এক লাখ টাকায় ৫ বা ৬ হাজার টাকা সুদ বা মুনাফা দিবে। পারভেজ ইকবাল চিন্তা করলেন বাংলাদেশের কোন ব্যবসায়/ ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে টাকা বিনিয়োগ করলে তিনি মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা সুদা বা মুনাফা পাবেন না।’ ‘ভিকটিম নিকটতম আত্মীয় ও ব্যাংকে দায়িত্বশীল পদে চাকরি করায় পারভেজ ইকবাল ভিকটিমকে বিশ্বাস করে অল্প সময়ে ভাল লাভ হবে দেখে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব বা কারো সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া ভিকটিমকে ঋণ দেয়া শুরু করেন। আসামি পারভেজ ইকবাল নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মূলধন থেকে পরবর্তীতে ভিকটিমের সহায়তায় ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এবং আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধব থেকে ধার করে ভিকটিমকে ২০১৪ সালের আগস্টের ৭ তারিখ থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্ব মোট ৪১ কোটি ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৫০ টাকা ঋণ প্রদান করেন। ভিকটিম পারভেজ ইকবালকে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত ১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা সুদ ও মূলধন বাবদ পরিশোধ করেন। ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য বিভিন্ন সময়ে তারিখ দিলেও ভিকটিম মোরশেদ চৌধুরী আসামি পারভেজ ইকবালকে মূলধন বা সুদের কোন টাকা পরিশোধ করেননি। তবে ভিকটিম। প্রসঙ্গত ২০২১ সালের গত ৭ এপ্রিল ভোরে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন মিমি সুপার মার্কেট সংলগ্ন হিলভিউ আবাসিক এলাকায় নাহার ভবনের ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি পূর্ব মাদারবাড়ির বাসিন্দা আব্দুল মোমিন চৌধুরীর ছেলে। এ ঘটনায় মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছেন। এতে মোরশেদের দুই ফুফাত ভাই জাবেদ ইকবাল চৌধুরী ও পারভেজ ইকবাল চৌধুরীসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য দুইজন হলেন- সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দিন ও যুবলীগ নেতা শহীদুল হক চৌধুরী রাসেল।















