সাবেক রাষ্ট্রদূত আলী কায়সার হাসান মোর্শেদের মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত গভীরভাবে শোকাহত। তার মৃত্যু আমার কাছে ব্যক্তিগত আঘাতের সামিল। তার মেয়ে লামিয়া মোর্শেদ ইউনূস সেন্টারের জন্মলগ্ন থেকে এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করে আসছে। এ সুবাদে রাষ্ট্রদূত মোর্শেদের সাথে আমার গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। তিনি কূটনীতিবিদ হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করার কারণে লামিয়া ও তার ভাই-বোনরাও বিভিন্ন দেশে থেকে বড় হয়েছে। বাবার কর্মস্থলের ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে লামিয়ারা ভিন্ন ভিন্ন দেশ এবং ভিন্ন ভিন্ন স্কুল-কলেজ, ভাষা ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। এ কারণে তাদের পৃথিবী আবর্তিত হয়েছে তাদের পিতা-মাতাকে কেন্দ্র করেই এবং তারাই ছিলেন তাদের সত্যিকার পৃথিবী।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত কায়সার মোর্শেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক বার্তায় নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন মন্তব্য করে বলেছেনঃ লামিয়ার কারণে রাষ্ট্রদূত মোর্শেদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় এবং আমরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠি। তিনি ছিলেন অসাধারণ চমৎকার একজন পিতা। তিনি তার সন্তানদের বিশ্ব নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার পাশাপাশি নিজের শেকড়ের কথা, নিজ দেশের সংস্কৃতিকে সম্মান করতে শেখা এবং নিজ দেশের সমস্যাগুলোর সমাধানে কাজ করার প্রত্যয় তাদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করে দেন। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি।
ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তার ছিল সুগভীর জ্ঞান। আইন বিষয়ে লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণের কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।
ড. ইউনূস বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড ল’ কলেজের মতো সুবিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার সুযোগ তার পেশাগত জীবন ও কর্মে গভীর সাফল্য ও অসাধারণ উত্তরাধিকারের সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের সমাজে তার অবস্থান এবং কূটনীতিবিদ হিসেবে পেশাগত দায়িত্বে তার নিবেদিত ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অবদান দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তাকে স্মরণীয় করে রাখবে।
কূটনীতিবিদ হিসেবে তার দায়িত্ব শুরু থেকেই ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। একটি সদ্য জন্মলাভ করা এমন এক দেশের প্রতিনিধি হিসেবে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিল যে-দেশের নামই তখন অনেকেই শোনেননি। এই অবস্থায় নিজেকে ও নিজের দেশকে পরিচিত করা এবং অন্যদের সাথে একটি শক্তিশালী ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ ছিল। কূটনীতিবিদ হিসেবে যেখানেই, যে-পদেই তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধানের দায়িত্বসহ, দেশের নবীন ও ভবিষ্যত কূটনীতিবিদদের উপর তিনি তার প্রজ্ঞা, অন্তদৃর্ষ্টি ও দূরদৃষ্টির গভীর প্রভাব রেখে গেছেন।
একজন ভীষণ কৌতূহলী মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রদূত মোর্শেদ আমাদের কার্জকর্ম সম্বন্ধে সবসময় খোঁজখবর নিতেন। তার সাথে আমার পরিচয় তিনি লামিয়ার পিতা ছিলেন এ-কারণে হয়নি, বরং লামিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে সে তার সন্তান ছিল এ-কারণে। লামিয়ার সাথে আমাদের পরিচয়ের আগে থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকাশনা, পুস্তিকা, নিবন্ধ, নিউজলেটার, প্রতিবেদন ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন এবং এগুলি লামিয়াকে পাঠাতেন, লামিয়া লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স-এ ভর্তির আগে থেকেই এবং সেখানে অধ্যয়নের সময়েও। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকান্ড নিয়ে তিনি বিশেষ গর্ববোধ করতেন এবং এই গর্ব তিনি তার মেয়ে লামিয়ার মধ্যেও সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। লামিয়া লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পরই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন গ্রামীণ ব্যাংকে ইন্টার্ণশীপ করার জন্য। তারা পিতা-কন্যা দুজনেই গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে, লামিয়া গ্রামীণ ব্যাংক পরিবার ছেড়ে চলে যাবার কথা আর কখনো ভাবতেই পারলো না।
রাষ্ট্রদূত মোর্শেদ আমাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নেবার কারণে লামিয়ার একটি দৈনন্দিন কাজ হয়ে দাঁড়ালো আমাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে তাকে ব্রিফ করা এবং তার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। এতে তিনি আনন্দ পেতেন। আমাদের কাজকর্ম তার আনন্দের অন্যতম উৎসে পরিণত হলো। তিনি এই ভেবে গর্ব অনুভব করতেন যে, তার মেয়ে এই অগ্রযাত্রায় চালকের ভূমিকায় আছে।
রাষ্ট্রদূত মোর্শেদের এই মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত শোকাহত। তার মৃত্যুতে জাতি এক দেশপ্রেমিককে, এক সফল কূটনীতিবিদকে এবং দেশ ও মানুষের সেবায় নিয়োজিত এক মহান কর্মবীরকে হারালো। যারা তাকে চেনেন ও তার সাথে কাজ করার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাদের কাছে তিনি তার বিনয়, আন্তরিকতা, সহজ-সরল জীবনাচার এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীতে তার সুগভীর প্রজ্ঞার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার মৃত্যুতে আমরা হারালাম এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে, একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিককে এবং দেশের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে গৃহীত কর্মকান্ডের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে। তাকে জানার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাদের কাছে রাষ্ট্রদূত মোর্শেদের দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা ও মহানুভবতা সবসময় দেশ ও সমাজের উন্নয়নে কাজ করে যেতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
আমরা সবসময় তার অভাব অনুভব করবো। মহান আল্লাহ তাকে চির শান্তিতে রাখুন।
উল্লেখ্য, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত আলী কায়সার হাসান মোর্শেদ গত ২২ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ নভেম্বর তিনি হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি ২ মেয়ে, একমাত্র ছেলে সহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।














