সিলেটের চাঞ্চল্যকর বন্দর পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন চালিয়ে রায়হান নামক যুবককে হত্যার ঘটনা সিলেটসহ পুরো দেশবাসীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর সেই মামলার বিচার শুরু হয়েছে। মামলার চার্জশিজ গ্রহণের মধ্য দিয়ে গতকাল বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। আদালতে নিহত রায়হানের মা, স্ত্রী, চাচাসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। আদালত প্রাঙ্গণে তারা গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, কিছুদিন আগে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে মামলার তদন্তের স্বার্থে বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস ও হারুনুর রশিদকে তাদের মুখোমুখি করা হয়। তখন আসামিরা রায়হানের মায়ের পা ধরে ক্ষমা চান। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দেন, আসামিদের তারা কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।
মহানগর পুলিশের আদালত পরিদর্শক প্রদীপচন্দ্র দাশ জানান, বাদীপক্ষ নারাজি না দেওয়ায় চার্জশিট দাখিলের প্রায় সাড়ে চার মাসের মাথায় গতকাল তা আদালতে গৃহীত হয়েছে। অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর আদালতের বিচারক আবুল মোমেন চার্জশিটটি গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি ফাঁড়ির সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ গায়েবকারী আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার সময় গ্রেপ্তারকৃত সব আসামি হাজির ছিলেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী এমএ ফজল চৌধুরী জানান, চার্জশিটে নারাজি দেওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। তাই নারাজি দেওয়া হয়নি। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করেছেন।
আকবরদের ক্ষমা করবেন না রায়হানের মা : গতকাল চার্জশিট গ্রহণের পর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় সালমা বেগম ও হাবিবুল্লাহর। তারা জানান, কিছুদিন আগে রায়হান হত্যা মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের স্বার্থে রায়হানের মা সালমা, স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী ও সৎ বাবা হাবিবুল্লাহকে পুলিশ সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে নিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ করে। ওই সময় কারান্তরীণ আসামি বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস ও হারুনুর রশিদকে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের সামনে নিয়ে আসা হলে তারা রায়হানের মা ও সৎ বাবার পা ধরে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চান। এ সময় তারা সালমা বেগমকে বলেন, ‘আমরা ভুল ইনফরমেশন পেয়ে রায়হানের মতো ভালো একটি ছেলেকে নির্যাতন করেছি। আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করে দিন।’ তবে তাদের এমন অনুনয়-বিনয়ে মন গলেনি সালমা বেগমের। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেও তো তোমাদের কাছে সেদিন প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু তোমরা সেদিন পাষ- ছিলে। আমার ছেলের প্রাণ ভিক্ষা দাওনি। তাই আজ আমরাও তোমাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করব না।’
উল্লেখ্য, গত বছর ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট শহরের আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনি সেখানে মারা যান। পরদিন তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্তে প্রথমে পুলিশ ছিল। পরে ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। গত ৫ মে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ১ হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
যে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাদের পাঁচজনই পুলিশ সদস্য। তারা হলেন বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটুচন্দ্র দাস ও হারুনুর রশিদ।
অভিযুক্ত অপরজন আবদুল্লাহ আল নোমান, যার বাড়ি কোম্পানীগঞ্জে। তার বিরুদ্ধে ঘটনার পর সিসি ভিডিও ফুটেজ গায়েব করার অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান এখনো পলাতক রয়েছেন। একাধিক সূত্র বলছে, তিনি ভারতে পালিয়ে থাকতে পারেন।
রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তার শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা উল্লেখ করা হয়।
এ ঘটনার পর দেশজুড়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় তখন গেল বছরের ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মূল অভিযুক্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা পুলিশ।