তিমির বনিক,মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: বন্য প্রাণি হাতি, আকৃতিগত দিক থেকে প্রাণিদের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী। বন্য (জংলি) হাতিকে মানুষ ভয় পায়, কেননা এগুলো পাহাড় থেকে বস্তিতে নেমে এলে মানুষের জান মালের ক্ষতি করে।
তবে এই বন্য প্রাণি হাতিকেই মানুষ (মাহুত) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পোষ মানায় এবং বিভিন্ন কাজ করিয়ে টাকা রোজগার করে। কাজ করার সামর্থ্য অনুযায়ী হাতির মূল্য ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা হয়ে থাকে। আবার হাতির দাঁতও লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি হয়। পালিত হাতির বাচ্চা জন্মের আড়াই বছর থেকে ৫ বছরের মধ্যে তাকে পোষ মানাতে হয়। বেশ ব্যয় সাপেক্ষ এই কর্মযজ্ঞটি চলে তিন মাসের ও বেশি সময়। জুড়ী উপজেলায় একটি হাতি শাবককে পোষ মানানো (স্থানীয় ভাষায় হাঁদানি) চলছে।
সরেজমিনে মঙ্গলবার উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের কাটাগাং গহীন জঙ্গল এলাকায় দেখা যায়, হাতির বাচ্চাকে পোষ মানানো হচ্ছে। এ কর্মযজ্ঞ দেখতে সেখানে হাজারো আবালবৃদ্ধবনিতা ভিড় করেন। হাতি হাঁদানো কাজের কয়েকটি ধাপের প্রথম ধাপ শুরু হয় মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায়।
প্রশিক্ষিত ২টি হাতি (শাবকের মা ও বোন) নিয়ে মাস্টার (প্রশিক্ষক)-এর নেতৃত্বে ৫ জন সহকারী প্রশিক্ষক ও কয়েকজন সহকারীসহ ১০ থেকে ১২ জন মাহুতের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ কাজ চলে। যথাযথ নিয়ম মেনে প্রশিক্ষিত হাতিগুলো দিয়ে বাচ্চাটিকে বেষ্টন করে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে বেঁধে ফেলা হয়।
বাচ্চাটিকে বাঁধার কৌশলটাও ব্যতিক্রম। আগে থেকেই মাটিতে গাছের চারটি খন্ড পুঁতে রাখা হয়। নির্ধারিত স্থানে যাওয়া মাত্র প্রথমে বাচ্চার গলা রশি দিয়ে গাছের সাথে বাঁধা হয়। একই সাথে সামনের দুই পা সামনের গাছের সাথে এবং পিছনের দুই পা পিছনের গাছের সাথে বাঁধা হয়। এ সময় বাচ্চা গগনবিদারী চিৎকার দিতে থাকে এবং সমস্ত বাঁধন ছিন্ন করে মুক্ত হবার প্রানপণ চেষ্টা করে। মা হাতি সংযত রাখাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে বাচ্চাকে বাঁধতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগে। যদিও এ কাজে ঘন্টার উপরে সময় লাগার কথা।
এ কাজটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আর এর মধ্য দিয়েই হাতি হাঁদানোর প্রথম দিনের মূল কাজ শেষ হয়। দ্বিতীয় দিন বাচ্চাকে ছেড়ে প্রশিক্ষিত দু’টি হাতি সহযোগে কোন এক ছড়ায় নিয়ে গোসল করানো সহ ৪/৫ ঘন্টা ঘুরিয়ে আবার নির্ধারিত স্থানে এনে বেঁধে রাখা হয়। এভাবে চলবে তিন মাস। এ সময়ে বাচ্চার পা গুলো খাল পড়ে ঘা হয়, ঘা থেকে পচন ধরে। তবে খাদ্য ও চিকিৎসা দেয়া হয় নিয়মিত।
এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাচ্চাকে বিভিন্ন সংকেত বুঝিয়ে দেয়া হয়, শিখিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন কাজের কৌশল। প্রশিক্ষণ শেষ হলেই হাতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ। প্রশিক্ষিত হাতি দিয়েই গাছ টানা, পড়ে যাওয়া গাড়ি তোলা, অতিথিকে অভিবাদন জানানো, সার্কাসে খেলা দেখানোসহ বিভিন্ন কাজ করানো হয়।
মাহুত আহমদ আলী পংকী জানান, মাস্টার (প্রশিক্ষক) আকবর আলীর নেতৃত্বে সহকারী প্রশিক্ষক রহমত আলী, ইছমাইল আলী, ফুলু মিয়া এবং আহমদ আলী পংকীসহ কয়েকজন সহকারী এই প্রশিক্ষণ কাজে অংশ নিয়েছেন। সম্পূর্ন কাজ সম্পন্ন করতে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হবে।
আলাপ কালে মাস্টার (প্রশিক্ষক) আকবর আলী বলেন, তিন মাস পরেও প্রশিক্ষণের আরো কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। তা সঠিক ভাবে সম্পন্ন হবার পর এই হাতিকে দিয়ে যে কোন কাজ করানো যাবে।
হাতি মালিক উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর নিবাসী নিপার রেজা জানান- হাতি প্রশিক্ষণের দৃশ্যটি দেখতে মানুষের জন্য আনন্দ দায়ক হলেও প্রক্রিয়াটি বাচ্চার জন্য কষ্টদায়ক।
তবুও তাকে পোষ মানানোর এ কাজটি না করলে হাতিটি জংলি হাতির মত আচরণ করবে। মানুষের জান-মালের ক্ষতি করবে। প্রশিক্ষণের জন্য এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে নেই। প্রশিক্ষণকালে অসুস্থতার কারণে বাচ্চাকে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ঔষুধও খাওয়াতে হয়।