মু আব্দুল হামিদ টিপু : সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা, যার বেশির ভাগ মানুষ প্রবাসী ।বাড়ির সামনে বড় বড় রঙিন ফটক এবং বহুতল প্রাসাদসম বাড়ি বিশ্বনাথের বাসিন্দাদের অঢেল সম্পদের কথা বলে দেয়। তবে রামপাশা ইউনিয়নের আমতলী গ্রাম এর ব্যতিক্রম। এখানে বসবাসরত ৫০০ টি পরিবারের মধ্যে ৯০ ভাগ পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য প্রতিবন্ধী, যা শারীরিক এবং মানসিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয়টি বিদ্যমান। বিশাল এই গ্রামটিতে কয়েকটি পাকা বাড়ি থাকলেও বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল অপ্রতুল । স্যানিটারি টয়লেটগুলির অবস্থা তো একেবারেই নাজুক।
এ বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এখনো অজানা আছে । স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নন কমিউনিকেশন ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি) প্রোগ্রাম প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে। এনসিডিসির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডাঃ মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, “৪০০ প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে একটি গ্রাম, এ সম্পর্কে আমরা কোনও তথ্য পাইনি।” তিনি আরও জানান, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) রোগের প্রাদুর্ভাব তদন্ত করে। তবে এটি প্রতিবন্দী নিয়ে কাজ করে না। সুতরাং, আইইডিসিআর এই গ্রামের প্রায় ৪০০ প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাপারে অবহিত নয়। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন আইইডিসিআর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন যে আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ নেহাল করিমের মোতে একটি গ্রামেই ৪০০ প্রতিবন্ধী থাকা সত্যি অবাকের বিষয় এবং এটি উদ্বেগজনক। তিনি আরো বলেন অবশ্যই, এই গ্রামে এমন কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যার ফলস্বরূপ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্ম হয়। এই গ্রামে প্রতিবন্ধীদের উপর গবেষণা করা অত্তান্ত জরুরি। তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসনের উচিত দ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি অবহিত করা।
গ্রামের মাওলানা জনাব আবুল খায়েরের দুই সন্তান হলো রাফি মিয়া(৬)এবং সাফি মিয়া(২) । তিনি জানান,তার সন্তানের কেউই জন্মের পর থেকেই হাঁটতে পারে না ,চলাফেরা করতে পারেন না এমনকি কথা বলতেও পারেন না। উনার ছেলেদের সম্পর্কে মাওলানা আবুল খায়ের বলেন, “যে বয়সে শিশুরা হাঁটতে শিখেছে, তারা উঠে বসতেও পারতো না। আমি তাদেকে চিকিত্সার জন্য সিলেট এবং ঢাকা নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছি ,কিন্তু কোনো লাভ হয়নি ।”
গ্রামের আরেকজন হলেন ,আব্দুল মতিন । তার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তার ঘরেই রয়েছে ১৪ বছর বয়েসী মেয়ে মৌসুমী বেগম, যে জন্মের পর থেকেই হাটতে পারেনা . অভাবের কারণে ডাক্তারের কাছে ও নিয়ে যেতে পারছেন না। শশুঁটকি বিক্রেতা মতিনের পরিবার রয়েছেন পাঁচ সদস্যঃ – দুই ছেলে,এক মেয়ে এবং স্ত্রী।
তিনি বলেন, “যেখানে আমার পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানেমেয়ের চিকিৎসা কি করে করবো? আমার পক্ষে এটা কঠিন।”
বিশ্বনাথ উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্র জানায়, তারা প্রতিবন্ধী সংখ্যার তালিকা তৈরি করতে ২০১৩ সালে গ্রামে একটি ঘরে ঘরে জরিপ চালিয়েছিল। প্রতিবন্ধীদের পিতামাতা বা অভিভাবকদের তখন তাদের ওয়ার্ডের নাম নিবন্ধনের জন্য সমাজসেবা অফিসে যেতে হয়েছিল।
সূত্রগুলি আরও জানিয়েছে, যে জরিপের ভিত্তিতে ইউনিয়নে বর্তমানে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী হচ্ছেন ৫৯৯ জন, তবে কেউ কেউ এই তালিকা থেকে বাদ ও পড়তে পারেন।
বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আবদুর রহমান মুসা বলেছিলেন, “এটি একটি ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। পরিবেশটি অত্যন্ত ওস্বাস্থ্যকর। দারিদ্র্য, অপুষ্টি এবং মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে প্রতিবন্ধী অনেক শিশুর জন্ম হয়। ”
“আর কিছু সংখক শিশু জন্মের পরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। এখানে জন্মের হার খুব বেশি।”
ডাঃ নাফীছুর রহমান, যিনি প্রতিবন্ধী নিয়ে কাজ করেন। তিনি জানান,”বহুবিধ কারণে মানুষ প্রতিবন্ধী হতে পারে।”
“অপুষ্টি, বাল্য বিবাহ, গর্ভাবস্থার যত্নের অনুপস্থিতি, আয়োডিনের অভাব, আর্সেনিকের অত্যধিক প্রসার, বাড়িতে শিশু প্রসব – প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্মের অন্যতম কারণ হতে পারে। ”
তিনি বলেন, এই গ্রামে প্রতিবন্ধিতার কারণ বের করতে একটি গবেষণা অতীব প্রয়োজন।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ প্রেমানন্দ মণ্ডল বলেছিলেন, “একই গ্রামে এত বেশি সংখ্যক প্রতিবন্ধী আশঙ্কাজনক। এটি অপুষ্টি বা আয়রনের ঘাটতির কারণে হতে পারে।”