বিশ্বনাথের শিক্ষা বিস্তারে চার বছর আগে জান্নাতবাসী আমাদের প্রিয় হেড স্যার জনাব তজম্মুল আলী স্যারের অসামান্য অবদান রয়েছে। বলা যায় উনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সমগ্র উপজেলায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে । নির্হংকারী এই মানুষটা বিশ্বনাথের হাজার হাজার ছাত্রের ছিলেন অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ । শিক্ষক হিসেবে যার শুরু এবং দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত্য সুনামের সহিত রাম সুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান করছেন । জন্ম দিয়েছেন হাজার হাজার ছাত্র যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বব্যাপী।
আমি সৌভাগ্যবান যে আমার শিক্ষাজীবনে বেশ কিছু ভালো শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করতে পেরেছি। সেটা দেশে হোক আর বিদেশেই হোক। সকল শিক্ষকের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। মাত্র একজন শিক্ষককে বাছাই করা আসলেই কঠিন। তবে আমার জীবনে যে সকল শিক্ষকের আদর্শ ও শিক্ষা খুব গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে তাদের মাঝে অন্যতম হলেন জনাব তজম্মুল আলী স্যার।
হেনরি এডামস এর একটি কথা আজ খুব মনে পড়ছে “ শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকালে গিয়েও শেষ হয় না “। সে কথা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি । আজ যাঁর কথা বলবো তিনি নিছক পাঠদান কারী শিক্ষক নন , তিনি জ্ঞান বুদ্ধ , তিনি আত্মার মিস্ত্রী , তিনি ভরা কলসের মতো ।
অযুত জ্ঞানের মাঝেও কখনও তাঁর মধ্যে এক চিলতে অহংকার দেখিনি । কবি গোলাম মোস্তফার শিক্ষক নিয়ে একটা লাইন বলি “ পিতা গড়ে শুধু শরীর , মোরা গড়ি তার মন , পিতা বড় কিবা শিক্ষক বড় – বলিবে সে কোন জন ? “ তিনি আমাদের পিতার মতই ছিলেন বটে । শিক্ষক হিসেবে আমি তার কাছে পড়ার ও জানতে চাওয়ার ক্ষুদা বাড়ানো শিখেছি ।
স্বামী বিবেকানন্দের কথা বললে একটা কথা বলতেই হয় ব্যক্তির আত্মা হতে অন্য আত্মায় শক্তি সঞ্চারিত হলেই যদি তাকে গুরু বলে তবে তজম্মুল স্যার আমার গুরু , আমি বা আমরা তার অযোগ্য শিস্য। শিক্ষকের কথা ভাবলেই অনেকের মাথায় যে রাগী ও বেত হাতে দাঁড়ানো একজন শিক্ষকের চিত্রটি আসে তজম্মুল স্যার কিন্তু মোটেও এমন ছিলেন না। উনি ছিলেন ছাত্রদের প্রতি সর্বদা আন্তরিক এবং সবাইকে সাহায্য করতে উৎসাহী। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান না করলেও উনার ছিল সর্ব বিষয়ে অগাদ জ্ঞান। বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ে উনার জ্ঞান ছিল অতুলনীয়। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন সৎ চরিত্রের সহজ সরল জীবনে বিশ্বাসী মানুষ যার জন্য তিনি ছিলেন সকলের কাছে অত্তান্ত শ্রধ্বার পাত্র। সবাই উনার ছাত্র না হলেও সবার কাছে উনি ছিলেন হেড স্যার। স্যারের সুদীর্ঘ সময়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল। আমার মনে আছে, স্যার ক্লাসে আসলেই আমরা জানতাম উনি ইংরেজিতে বাক্য তৈরী করার জন্য একে একে দাঁড়করাবেন ।
আমরা যারা মোটামোটি ভালো ছাত্র ছিলাম তারাকোনো সময় না পারলেও উনার টার্গেট থাকতো বন্ধু খয়েরের ( ড: আবুল খায়ের – বর্তমানে ইন্টেল কোম্পানিতে রিসার্চারের দায়িত্বে আছে ) এর উপর। সে চটপট করে উত্তর দিয়ে দিতো। আর সেই জন্যই খয়ের ছিল স্যারের অত্তান্ত প্রিয় ছাত্র। তাকে নিয়ে স্যারের অনেক স্বপ্ন ছিল। তাকে দিয়ে বোর্ডে স্ট্যান্ড করাবেন । আর সে জন্যই আমাদের পুরো ব্যাচের ভালো রেজাল্টের জন্য স্যার আলাদা কোচিংয়ের ব্যাবস্থা করলেন। আমার মনে হয় আমাদের ব্যাচ এসএসসি তে তখন পর্যন্ত সব চেয়ে ভালো ফলাফল করেছিল। আমরা ৫ জন লেটার সহ ষ্টার মার্ক্স্ পেয়েছিলাম। খয়ের মাত্র ৭ মার্কসের জন্য যখন বোর্ডে স্ট্যান্ড করতে পারেনি ,তখন দেখেছি স্যারের বিমর্ষ চেহারা।
আজ ভাবি সবাই বলে ,শিক্ষক হলেন পিতার মতো। সত্যি তাই,একজন পিতা যেমন তার সন্তানের ভবিষতের জন্য চিন্তিত থাকেন তেমনি একজন আদর্শ শিক্ষক ও তার ছাত্রের জন্যই তেমন করে থাকেন। আর আমাদের তজম্মুল স্যার তো ছিলেন বেতিক্রম। উনার সংস্পর্শে যে যেতে পেরেছিল তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হয়ে যেত। আফ্সোস ! আজকের মতো যদি স্যার কে আগে চিনতাম তাহলে হয়তো উনার থেকে অনেক কিছুই নিতে পারতাম। তারপর ও বলবো আমার এই ক্ষুদ্র শিক্ষা জীবনে হেড স্যারের অবদান অনস্বীকার্য। আজ স্পষ্ট মনে পড়ছে, এসএসসি পাশ করে যখন পারিবারিক সিদ্ধান্তে মফস্বল কলেজে ভর্তি হই , তখন একদিন সার আমাকে বলেছিলেন সবার জন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্টান নয়,তোমাদের জন্য শহরের উন্নত কোনো কলেজই উত্তম। তোমরা জাতিকে অনেক কিছুই দিতে পারবে ।
সেদিন স্যারের কথাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও আজ সেটা টিকই বুঝতে পারছি। স্যারের সাথে আমার আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ছে, তখন ২০০১ সাল। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যখন এমবিএ করার জন্য বিলেতের ভিসা পাই। স্যারের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য একদিন স্কুলে যাই। সেই দিনস্কুল ছিল বন্ধ। তাই স্কুলের পাশেই স্যারের বাসায় হাজির। আমার ভিসা পাওয়ার সংবাদে সেই দিন স্যারের মুখে যে হাসিটি দেখেছিলাম, আজ পর্যন্ত তা ভুলতে পারি নি।
এখানে বলা রাখি , হেড স্যারের মুখে হাসি দেখেছেন এমন ছাত্র খুবই কম। স্যার সবসমই গম্ভীর থাকেতেন, যেমন থাকেন অত্যান্ত জ্ঞানী, গুণী এবং দার্শনিক ব্যাক্তিরা। সার ছিলেন অনেক বড়ো মাপের দার্শনিক ব্যাক্তি। স্যার আমাকে উনার সেই সহজ সিলেটি ভাষায় শুধু বলেছিলেন ” লন্ডন গিয়া ফাউন্ড গোনাত লাগিস না। ফাউণ্ডের ফিচে না দৌড়াইয়া পড়ালেখা কোরিয়া ডিগ্ৰী নিবে, দেখবে, ফাউন্ড তো ফিসে গুরবো ” জানি না কতটুকু পড়ালেখা করতে পেরেছি , কিন্ত স্যারের কথাটি সবসমই মনে পড়তো। বিশেষ করে বিলেতের সেই কঠিন সময়ে যখন মনে হতো আর পারি না ! তখন স্যারের সেই উক্তিই হয়তো আমাকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে । তাই স্যারের কাছে আমি আজীবন ঋণী। “তজম্মুল আলী ” একটি নাম নন , তিনি একটি প্রতিষ্ঠান । এতো কিছু জানতেন এবং জানাতেন । মনে হতো তার পাশে থাকলেই বুঝি পুন্য হয়। স্যার সারাজীবন ছাত্রদের মঙ্গলের জন্যে সব দিয়েছেন কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চাননি। বাতিঘর হয়ে আলো জ্বালিয়েছেন, কিন্তু নিজে সব সময় থেকেছেন অন্তরালে ।
আজ উনি দূরে …অনেক দূরে…কিন্তু উনার রেখে যাওয়া বাতিগুলো জাতিকে পথ দেখিয়ে যাবে এটা নিশ্চিত । আল্লাহ্আমার স্যারকে জান্নাতবাসী করুন । আমীন !
লেখক: সাবেক ছাত্ৰ। রাম সুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়। বর্তমানে ব্রিটেনে আইন পেশায় জড়িত