করোনা ভাইরাস মহামারীর জেরে উল্টেপাল্টে গেছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত পোশাক খাতেও। এক দিকে যেমন বাতিল হয়েছে কোটি কোটি টাকার কার্যাদেশ, তেমনি এই স্থবিরতার জেরে কাজ হারাতে হয়েছে অনেক শ্রমিককে। ফলে অনেক শ্রমিকই এই মহামারীর মধ্যে কষ্টে জীবননির্বাহ করছেন। পোশাক শ্রমিকদের এই দুরবস্থা নিয়ে গত রবিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি। এতে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। হঠাৎ করে জীবন-জীবিকা হরণ হওয়ায় চাপে পড়েছেন বহু কারখানার শ্রমিকরা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তৈরি পোশাক বাংলাদেশের রপ্তানি আয়োর একটি প্রধান উৎস। অথচ এখানে কাজ করা শ্রমিকরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। মৌসুমী নামে ২২ বছর বয়সী এক শ্রমিক জানান, দীর্ঘ সময় বেকার থাকার পর গত জানুয়ারিতে তিনি একটি কারখানায় কাজ পান। মার্চ পর্যন্ত প্রতিমাসে সেখানে তিনি ১০ হাজার টাকা বেতন পেতেন; কিন্তু দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত মার্চে সব গার্মেন্ট কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার। অবশ্য সীমিত জনবল নিয়ে এপ্রিলে আবার খোলে কারখানা; কিন্তু তখনে তিন মাস মৌসুমীকে কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। এর পর ১ আগস্ট জানানো হয়, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সিএনবিসিকে মৌসুমী বলেন, বরখাস্তের কারণ হিসেবে কারখানা কর্তৃপক্ষ তখন শুধুই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা বলেছে।
বর্তমানে নিজের আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন দুলালী। তিনি বলেন, আমরা এখন মারাত্মক সংকটের মধ্যে আছি। বাসাভাড়া বাকি পড়েছে ১৬ হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে আমি বাড়ির মালিকের বাসায় রান্নার কাজ করছি। তা থেকে মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বেতন পান। এখন সেটা দিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন তারা।
মৌসুমী, দুলালীর মতো মোট ৬ পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে ফোনে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ফেডারেশনের মাধ্যমে কথা বলেছে সিএনবিসি। এই শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ জানিয়েছেন, মহামারীর মধ্যে চাকরি যাওয়ার পর তারা কাজ পেয়েছেন। অন্যরা এপ্রিল বা মে মাস থেকে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তবে তারা সবাই অতিরিক্ত আর্থিক সংকটের মধ্যে আছেন।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেসব খুচরা ব্র্যান্ডের অর্ডার উৎপাদনে চলে গিয়েছিল সেগুলোসহ বেশির ভাগ কার্যাদেশই বাতিল হয়। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে অন্তত ১১৫০টি কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ৩১৮ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিলের রিপোর্ট করেছে। এ বছর মার্চ এবং জুনের মধ্যবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের তুলনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত হারিয়েছে ৪৯০ কোটি ডলার। এ ছাড়া শেষ তিন থেকে চার মাসে বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলো ৭১ হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে।
বাংলাদেশের এই শ্রমিকদের নিয়ে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির শ্রম ও কর্মসংস্থানবিষয়ক অধ্যাপক মার্ক অ্যানার বলেন, এ শ্রমিকরা হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপন্ন শ্রমিক। এর মধ্যে যুব শ্রমিক, নারী শ্রমিক বেশির ভাগই দেশের ভেতরে অভিবাসী হয়ে পড়েন। ফলে তারা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে ছুটে আসেন। যাদের অনেকেরই কোনো সঞ্চয় থাকে না। তারা যা উপার্জন করেন তার ওপর ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। তাই যখন এসব শ্রমিককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন তারা। কখনো কখনো এসব শ্রমিকের গ্রামের বাড়িতে থাকা সদস্যরা তাদের ওপর নির্ভর করেন। তাই নানা দিক দিয়েই এই শ্রমিকরা ঝুঁকিতে থাকেন। এ জন্য তাদের কঠোর মূল্য দিতে হচ্ছে।