বিখ্যাত আমেরিকান লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা Michael Crichton-এর মতে–“If you don’t know history, then you don’t know anything. You are a leaf that doesn’t know it’s part of a tree.” পৃথিবীর যেকোনো জাতি বা গোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকর্মের নিদর্শন শোভা পায় তাদের জাদুঘরে। যেখানে সংরক্ষণ করা থাকে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ও প্রাগৈতিহাসিক মূল্যবান জিনিসপত্র এবং চিত্রকলা ও শিল্পকলা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জ্ঞান আহরণের জন্য প্রদর্শন করা হয় হাজার হাজার বছরের পুরনো মানব সভ্যতার নিদর্শন ও ইতিহাস।

হ্যাঁ প্রাচীন সভ্যতার শুরু থেকে আধুনিক মানব সভ্যতার সংরক্ষিত অনেক নিদর্শন এবং ইতিহাস জানতে ও দেখতে বিগত ১১’ই অক্টোবর গিয়েছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থীদের পরিদর্শিত, স্থাপত্যশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন ও সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়াম বা শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জাদুঘর পরিদর্শনে। প্রায় পনেরো একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত এক জাদুঘর একটু একটু করে দেখতে আর অজানা নানা তথ্য জানতে। যেখানে রয়েছে–মিশরীয় পুরাতত্ত্ব; নিকট প্রাচ্য পুরাতত্ত্ব; গ্রিক, এট্রাস্কান ও রোমান পুরাতত্ত্ব; ইসলামিক শিল্পকলা; ভাস্কর্য; সজ্জা সংক্রান্ত শিল্প; অঙ্কন শিল্প এবং ছাপা শিল্পসহ বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শনাবলীসহ মধ্যযুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের চিত্রকর্ম ও শিল্পকর্মের এক বিশাল সমাহার যা একদিনে দেখে শেষ করার মতো নয়। আমার বিশ্বাস এতক্ষণে আপনাদের বুঝতে বাকি নেই যে আমি কোন্ মিউজিয়ামের কথা বলছি! বলছি প্রাচীন নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি ফ্রান্সের নানা বিস্ময়ের আরেক বিস্ময় বিশ্বখ্যাত চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের এক আশ্চর্য সংগ্রহশালা “Musée du Louvre” বা “ল্যুভর মিউজিয়াম” এর কথা। প্যারিসকে বলা হয়, অর্ধেক নগরী আর অর্ধেক কল্পনা। এই কল্পনার রাজ্যেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জাদুঘর ল্যুভর। আধুনিক সভ্যতার পটভূমি ফ্রান্সের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বর্ণযুগ সম্পর্কে জানতে প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এখানে ভিড় করেন মিলিয়ন মিলিয়ন পর্যটক।

ল্যুভরকে প্রথমে দূর্গ হিসেবে তৈরী করা হয়েছিল এবং পরে রাজপ্রাসাদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। ল্যুভর এর পুরো বিল্ডিংটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করতে প্রায় ২০০ বছর সময় লেগে গিয়েছিলো। ন্যাশনাল এসেম্ব্লী ফ্রান্সের সিদ্ধান্তক্রমে ষোড়শ লুই ১৭৯৩ সালের ১০ আগস্ট ৫৩৭টি চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে ল্যুভর মিউজিয়ামটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে উদ্বোধন করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে গণ-জাদুঘর হিসাবে এর যাত্রা শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে জাদুঘরটিতে প্রায় ২০ হাজার শিল্পকর্ম যোগ করা হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে অনুদান ও অধিকৃতির মাধ্যমে জাদুঘরের সংগ্রহের সংখ্যা ও আয়তন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ল্যুভর বর্তমানে ৭২৭৩৫ বর্গমিটার বা প্রায় ৮ লক্ষ বর্গফুট প্রদর্শনীর জায়গা জুড়ে ৩৮০০০টি প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের বিশাল সংগ্রহশালা। ২০১৮ সালে ল্যুভর মিউজিয়াম রেকর্ড সংখ্যক ১০.২ মিলিয়ন দর্শনার্থী পরিদর্শন করেছেন। রেকর্ডসংখ্যক দর্শনার্থীর আগমনে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পকলা জাদুঘরের খেতাব এখন ল্যুভরের নিজের দখলে।
আমেরিকান স্থপতি আই.এম. পেইয়ের পরিকল্পনায় বিশেষ ভাবে নির্মিত গ্লাস পিরামিড আজ ল্যুভরের প্রতীক হিসাবে দেখা যায়। ১৯৮৯ সাল থেকে কাঁচের এই পিরামিড দিয়েই দর্শনার্থীদের জাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। মহামারি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে বিগত মার্চ মাসের ১৩ তারিখ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত প্রায় চার মাস লকডাউনে বন্ধ থাকার জেরে ৪০ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ল্যুভর মিউজিয়ামের। অবশেষে বিগত ৬ জুলাই থেকে দর্শনার্থীদের জন্য আবার খোলে দেওয়া হয়েছে “ম্যুজে দ্যু ল্যুভর”। তবে অনেক নিয়ম কানুন মেনেই প্রবেশ করতে হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে আসেন ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ। এবছর তার তিন ভাগের এক ভাগও হবে কিনা সন্দেহ। কারণ ল্যুভর মিউজিয়ামের দর্শনার্থীরা বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আসেন।

ল্যুভর যেমনি সৌন্দর্যের ধারক তেমনি ইতিহাসেরও বাহক। প্রাচীন সভ্যতার শুরু থে
কে আধুনিক সভ্যতার অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। পৃথিবীর বিস্ময়কর ও মহামূল্যবান অনেক চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের পাশাপাশি ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র আঁকা অমীমাংসিত রহস্যময়ী বিখ্যাত “মোনালিসা” ধরিত্রী’র আরো এক তাজ্জব শিল্পকর্ম। “মোনালিসা” যেনো ল্যুভরের ফ্লাস পয়েন্ট। সত্যিই ছবির চেয়েও সুন্দর এক সৃষ্টি। ১৯১১ সালে ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে বিখ্যাত এই চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যায়। প্রায় দুই বছর পর মোনালিসা’ চিত্রকর্মটি পুনরোদ্ধার করা হয় এবং চুরির দায়ে ফরাসী কবি গুলম এপোলিনেয়ারকে গ্রেফতার করা হয়।
ল্যুভর মিউজিয়ামের ইসলামিক শিল্পবিভাগ আমাকে আবেগ তাড়িত করেছে। ইসলামিক শিল্পবিভাগে সপ্তম শতক থেকে শুরু করে উনবিংশ শতকের স্থাপত্যশিল্প, ধাতব কাজ, সিরামিক, টেক্সটাইল, কার্পেট, পাণ্ডুলিপি ও আরো অনেক শৈল্পিক সৃষ্টি দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শনীর বিশাল গ্যালারি দেখে একজন মুসলিম হিসেবে যেমন গর্ববোধ করছি তেমনি সাম্যবাদী মানবিক মূল্যবোধ এবং শিল্পকলা ও শিল্পসাহিত্যের চারনভূমি প্রিয় ফ্রান্সের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।