আমি সাক্ষাত প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা পাই –——-
চলার সঙ্গি হতে হবে আমলদার———
বিশেষ করে হজ্ব কাফেলায়।
মাথাটা ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরছে। এত সব প্যাকেজের মধ্যে নিজেই ঘোরপাঁক খেতে শুরু করলাম। ডায়মন্ড, গোল্ডেন, সিল্ভার,ফাইভ স্টার, ত্রি স্টার, সিফটিং এই সেই কত কিছু ! কার সাথেই বা যোগাযোগ করব, কার মাধ্যমে যাব? ভেবে ব্যাকুল প্রায়। এই হুযুর, সেই হুযুর,মাদনি, মক্কি, বেরি পারি, কত সব হুজুর এই বাজারে। এই এজেন্সি,সেই সার্ভিস। আবার অনেকে মাছ-পানের দোকানের পাশে সাজিয়েছেন হজ ব্যবসা অথবা টাকা-পয়সা যারা দেশে পাঠান তারাও হয়ে পড়েন এই মৌসুমি হজ্ব ব্যবসায়ি। অনেক বৈচিত্র্য এই বাজারে, বিচিত্রময় ধর্মীয় হজ্ব সেবা। কেউ বা বলবেন এই ধর্মীয় কাজে যাবেন আমাদের সেবা করার সুযোগ দেন। আবার কেউ বা বলবেন আপনার টাকা থাকলেই যেতে পারবেন না এই সেই। মোদ্দাকথা আপনি এক ধুয়ার মধ্যে পড়লেন এবং আপনাকে এই ধুয়ার মধ্যে ‘’সবুরের’’ সুবিদা মুখী গুল্লি খাইয়ে এক ধরনের অবচেতন করে বড় সাহেবরা আরবের আতর মেখে ও রুমাল মাথায় পড়ে ঝাড় ফুক দিয়ে ২/৪ সপ্তাহ গুঢ়ের মধ্যে রাখবেন, এটা ধরে নেন নিশ্চিত। আপনি যদি গুঢ় কাটিয়ে একটু আপনার হিসেব নিকেষের প্রশ্ন তুলেন, অভিধা পেতে পারেন ‘’ বেজাল হাজী’’।
আপনি আমি চরকায় ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে কার বড়শীর চিপ হব আমরা নিজেই জানিনা, কিন্ত জানেন উনারা। আর কেউ জানুক বা না-জানুক বড় সাহেবরা জানেন অর্থাৎ যারা হজ্ব লাইসেন্সের মালিক। আপনি যদি সরাসরি উনাদের কাছে যান ভাল, না গেলেও কিচ্ছু আসে যায় না! আপনি আসবেন আসতে হবে উনাদের ব্যবসার ফাঁদে। আসবেন নব নামে, অতিরিক্ত পাউন্ড দিয়ে বা কোন সময় কপাল ভাল হলে কম জরিমানা দিয়ে, উনাদের দালালদের মাধ্যমে।
আমার মনে হয় এখানে দালাল ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন নেই। প্রতিটা বছর এই দালালরা এমনকি মাজে মধ্যে লাইসেন্স দারিরাও সহজ মনপলি মারতেছে। আমি তো এমন লাইসেন্স দারি ডাকাতের হাতে গিয়েও শেষমেস রক্ষা পেয়েছিলাম।
এমন অনেক ভদ্রলোক আছেন মুল এজেন্সির সাথে কথা বার্তা টাকা পয়সায় হয় নাই, তাই ফিরে আসছেন। অন্য নামের এজেন্সি, অন্য ব্যক্তির সাথে যাচ্ছেন কিন্ত ফ্লাইটে, এয়ার পোর্ট যেয়ে আস্তে আস্তে কী সুন্দর উনি যে এজেন্সির কাছ থেকে ফিরে এসেছিলেন তাহাতেই নিজের অজান্তেই মিশে যাচ্ছেন। পুরু হজ্ব কালীন সময় একি হোটেলে থাকেন, একি খাওয়া,একি সাথে জিয়ারত, কিন্ত নাম বহন করছেন ভিন্ন, কি আজব তামাশা। তখন ধীরে ধীরে জানতে পারেন যাদের মাধ্যমে এসেছেন মূলত আপনি যে এজিন্সিতে প্রথমে গিয়েছিলেন তাদেরই অলিখিত সাব-এজেন্ট। তাদের কোন লাইসেন্স নেই, ঐ বড় সাহেবেরই ছত্রছায়ায় উনার ব্যবসা করে আসছেন। তখন স্বভাবতই শুরু হয়ে যায় খবরা-খবর নেওয়ার পালা। কে কত দিয়ে আসলেন? যখন বুঝতে পারলেন মাথা পিছু ৩/৪ শ পাউন্ড ধরা খেয়েছেন, তখন মিজাজ যায় বিগরিয়ে। কাউকে বলতেও পারেন না, সইতেও পারেন না, নিজেই পড়ে যান রঙ্গয়ের তামাশায়। মাথায় রঙ খেলে, কোথায় গেছেন কি হবে আচরণ? বেমালুম ভুলে বসে থাকেন।
রঙের মানুষ রঙের আচমকা হজ্ব ব্যবসার উপাদান হয়ে পড়েন নিজের অজান্তেই। । চলছে দেদারছে রং চলছে, আমাদেরকে নিয়ে খেলারাম খেলছে। ধর্মের লেবাসে, ধৈর্যের বয়ানে- চলছে সার্কাস চলছে। জৌকাররা ফুলে ফেপে অতি অল্প সময়ে শুন্যপতি থেকে কোটিপতি হচ্ছে। ওরা দামান্দ হয়ে, শ্বশুর হয়ে,একি পরিবারভুক্ত হয়ে ভিন্ন নামে একি থালে খাইয়ে, একি বিচানায় শুয়িয়ে, ভিন্ন দরে আপনাকে আমাকে মামু বানাচ্ছে।
আমি যে গ্রপের সাথে গিয়েছিলাম ওরা তো একের ভিতরে তিন। মানে হল, সার্ভিস সব সমান কিন্ত আমরা জবেহ হয়েছি, ভিন্ন নামে ও ভিন্ন দামে। আমি গিয়েছিলাম মুল এজেন্সির সাথে এবং আমার ভাতিজী গিয়েছে সাব এজেন্সিতে। পাউন্ডের তফাৎ মাথা পিছু ৩০০। কি মজার হজ ব্যবসা তাই না? ওরা কিন্ত গিয়েছিল এমনকি কম দামি ফ্লাইটে ও আমাদের চেয়ে চার দিন কমের প্যাকেজ নিয়ে।
সেখানেও আপনি দেখবেন নির্লজ্জ স্বজনপ্রীতি, ধনী-গরীবের চটকদারি। আগা থেকে গুরা সবই হযবরল। এই সব হযবরল এর মধ্যে আমিও পড়ে গেলাম। সাথী হলেন এক দম্পতি। উনাদের খুব আশা ভরসা আমার উপর। আমার সাথে হাসি মুখে উনার ছেলে হজে যেতে দিবে। তাই আমাকে চেপে ধরলেন ঐ দম্পতি যাতে উনাদেরকে নিয়ে আমি হজে যাই। এদিকে আমার মা দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন, উনাকে নিয়ে তো যেতেই হয়। আল্লার নাম নিয়ে নিয়ত পাকা করে ফেললাম।
আমার এক ছোট ভাইয়ের হুযুর বন্ধু, উনি প্রতি বছর হজে মানুষ নিয়ে যান। উনার স্মরনাপন্ন হলাম। উনাকে বলতেই উনি বেজায় খুশি, খুশি যে আমার আম্মার সেবা করতে পারবেন বলে। আমিও খুশি হলাম যে, এমন একজন দরদি মানুষ পেলাম। তখনও হজের মৌসুম শুর হওয়া অনেক দূরে। নানাবিদ তথ্যে কান ঝালা পালা হয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে হজের কথা বের করবেন তো ডানে বামে আগে পিছে হজ ব্যবসায়ী। আপনার নিশ্চিত নিরবিঘ্ন যাত্রার সম্ভাবনা হয়ে পড়বে দুরহ। যাক, ঐ মৌলানা হুজুর হজ ব্যবসায়ী কাছে গেলাম প্রাথমিক জানা শুনার জন্য, উনার সাথে যাব একরকম মনঃস্থির করে রেখেছি। উনি বলেছেন আমার আম্মাকে সেবা করতে চান। কথা প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল বাজারে তো আরও অনেক কম দামে একি সুযোগ-সুবিধার প্যাকেজ আছে, কিছু কম রাখা যায় না? উনার সোজা সাপ্টা উত্তর ছিল ‘’ আমি তো আমার ব্যবসা মাথায় তুলতে পারি না’’। আমি উনার জবাব শুনে হকচকিয়ে গেলাম। আর এ ব্যপারে কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম। বুঝলাম উনি পাক্কা হজ ব্যবসায়ী। আবার যে কিনা আমার মাকে সেবা করতে চায়। উনার সেবা ও ব্যবসার হিসেব দেখে উল্টো পথে হাটা লাগালাম।
একটু হজ্ব বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দিতে শুরু করলাম। কিবলা নামক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের চমকে পড়ে গেলাম। ফারুক নামক লোকের সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি ঐ দিনই সৌদি থেকে এসেছেন। টাই সুট মাথায় টুপি, ব্রিক্ল লেইন দুতলা অফিস রুমে বসা। প্রাথমিক আলাপ আলোচনা সাড়লাম। আমার নাম উনি ৮ নং এ উঠিয়ে রাখলেন, যদিও আমি বলে আসলাম পরে জানাব।
মনে পড়ে গেল, আমার এক বন্ধুর হজ এজেন্সি আছে ওর কিছু পরামর্শ নেওয়া দরকার। সে খুব বস্তনিষ্ঠ তথ্য দিল, আমাকে ওর দিকে টানার কোন আবাস পেলাম না। উপরন্তর সে বলল যার মাধ্যমেই যাই, মক্কায় যে হোটেল দিচ্ছে সেটা যেন ওর সাথে আলাপ করে জেনে নেই, মান সম্মত আছে কি না?
ওর আচরণ আমাকে ওর কাছে টানল, আমি জানি ওর প্যাকেজের দাম বেশি, তারপরও মনে সায় দিচ্ছে ওর মাধ্যমে যাবার জন্য। আমার সহযাত্রীর সাথে আলাপ করে নিলাম। উনি এক বাক্যে রাজি এবং আমার বিচার বিশ্লেষণের উপর ছেড়ে দিলেন। যেহেতু মন স্থির করে ফেলেছি, দিন ক্ষন ঠিক করে ওর কাছে যেয়ে এই বছরের বুকিং এ আমার নাম লেখাব এই অপেক্ষায় আছি। সেই অপেক্ষা কালীন সময়ে কিবলা হজ গ্রপের ফারুক ফোন দিলেন, আমার সিদ্বান্ত জানাতে বললেন। আমি বলে দিলাম অন্য গ্রুপের মাধ্যমে যাচ্ছি।
ঐ বছরেই এই ফারুক নরপশু ৩০০ হাজীর ৭৫০,০০০ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়। এবং ওর ক্ষপরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক লোক আমাদের এজেন্সির সাথে অতিরিক্ত পাউন্ড খরচ করে হজে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের সিলেটের আম্বর খানার পারভেজ রশিদ চৌধুরী ভাই ও উনার স্ত্রী ছিলেন।
সেই কাঙ্কিত দিন উপস্থিত হল। সৌদি এয়ার লাইন্সের সরাসরি ফ্লাইটে ফজরের মুহূর্তে জেদ্দায় অবতরণ করলাম। মোটামুটি এক ধরনের নামাজের ব্যবস্তা করা জায়গায় নামাজ সেড়ে ইমিগ্রেসন করে বের হলাম। দরজার বাহিরে দুইদিকে দুটা করে স্বাভাবিক টেবিল রাখা। আছে এর আশে পাশে ২/৪ জন বালক অলস ভাবে দাঁড়িয়ে। দেখে বুঝা কঠিন টেবিল ও তাদের মধ্যে কি সম্পর্ক। মানুষজন যার যার মত হেঁটে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। আমার হাতে আমাদের চারটা পাসপোর্ট। আমার গ্রুপের সবাই আমার আগে চলছেন এমনকি আমার মা ও সহযাত্রীরা। টেবিলের পাশ দিয়ে চলে যাব এমন সময় নজরে পড়ল ২/১ জন লোক পাসপোর্ট দেখাচ্ছে। আমি একটা ফাকা টেবিলে সামনে যেতেই গদাই লস্করি গতিতে একজন এগিয়ে এসে ছুই, না’ছুই এমন ভাবে পাসপোর্টগুলি ধরে ওর সাথিদের সাথে দুনিয়ার সময় নিয়ে আলাপ অব্যাহত রেখে ব্যাংক ড্রাপ্ট নিয়ে পাসপোর্টে স্টিকার লাগিয়ে আমাকে উনি মুক্তি দিলেন। গ্রুপের দিকে অগ্রসর হব তখনই আমাদের গ্রুপ লিডার বললেন উনার শিশু সন্তানের ড্রাপ্ট লন্ডন থেকে আনেন নি, তাই উনি আমাকে উনার ২/৪টা পাসপোর্ট ধরিয়ে চলে গেলেন এয়ার পোর্টে ড্রাপ্ট করতে। আমি উনাকে বললাম, তাহলে আপনি আমার লাগেজ গুলি খেয়াল করে ট্রলি থেকে নামাবেন। আরও বেশ কিছু সময় নিয়ে পাসপোর্ট স্টিকার লাগিয়ে সবার সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি এমতাবস্তায় দেখলাম আমদের গ্রুপের লোকেরা ইতিমধ্যে লাইনে দাড়িয়েছেন। কিছু মুরব্বীর চেহারা দেখে কষ্ট লাগল, দৌড় দিয়ে কিছু পানির বোতল এনে উনাদের হাতে ধরিয়ে দিলাম। বাসে উঠার পূর্বে সব পাসপোর্ট এক করা হল। আবার সেই গ্রুপ লিডার আমার সাহায্য চাইলেন। আমকে বললেন দখেনতো কোন পাসপোর্টে কেউ ভুলে ড্রাপ্ট না দিয়ে চলে আসলেন কিনা? এখন যে পাসপোর্ট ধরি সেটাতেই দেখা যায়, ড্রাপ্ট নিয়ে চলে এসেছেন। ৯৭টার মধ্যে ৯৩টাতেই একি অবস্তা। সেই আবার ঐ গাট্টি নিয়ে চললাম সেই টেবিলে। আমার এই উপরি ঝামেলা কিছুটা কস্ট হলেও তেমন খারাপ লাগছিল না যতক্ষন না পর্যন্ত আমার লাগেজের খুজ করছিলাম। সব আনুসাঙ্গিক কাজ শেষ করে যখন আমার মা ও সহ যাত্রীদের দিকে খেয়াল নিলাম, তখন আমার পুরুষ সহযাত্রী জিজ্ঞেস করছেন আমাদের লাগেজ কোথায়? আমি তো হকচকিয়ে গেলাম ! আর হাতে সময় একেবারে নেই বললেই চলে। সবাই লাইন দিচ্ছে গাড়ীর জন্য, সবার লাগেজ আছে সাথে কিন্ত আমাদের একটাও নেই। আমার সাথী আমাকে এক প্রকার দমক দিয়ে দিলেন ‘’ যেখানেই যাও আছ খালি মানুষের লাগি অতা করা হথা করা’’( অর্থাৎ আমি শুধু আছি মানুষের সেবায়)। উনি যখন দেখলেন আমি মানুষের জন্য দৌড়াচ্ছি উনি তো পারতেন অন্যান্য লোকের মত লাগেজ গুলি নামিয়ে রাখতে। আমার গ্রপ লিডারকে বললাম আমার লাগেজ আপনি নামান নি ? আমার দিকে উনার নির্বাক দৃষ্টি দেকে মনে হল ,আমি উনাকে এমন প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। এমন অসহায়ত্ব অনুভব করলাম যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। হাজার লাগেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কেউ ইংলিশ কথা বলছে না কিছু জিজ্ঞেস করলে , আমি এখন কি উপায় করি। দু’চারটা চক্কর এই পাশ থেকে ঐ পাশ দিতেই প্রাণটা যেন প্রায় যায় যায়। আর খুজা খুজি করা যাবে না, হাল ছেড়ে দিয়েছি। ঐদিকে গাড়ি আবার যদি মিস করি সেই ভয় কুড়ে খাচ্ছে। আমার সাথীকে প্রবোদ দিয়ে বললাম,আমাদের পাসপোর্ট তো হারানো যায় নি, টাকা কড়ি সবই আছে। হজ করতে এসেছি সেটা হলেই হল। কাপড় চোপড় কেনা যাবে ইনশাল্লাহ।
সবে এই নিয়ত করেছি অনতিদুরে আমার লাল লাগেজ সম একটা লাগেজ চোখে ভাসল। এগিয়ে যেয়ে দেখলাম ঠিক আমার লাগেজই। এদিক সেদিক দৃষ্টি দিয়ে খুজতে লাগলাম বাকি লাগেজ। আলহামদুল্লিয়াহ, কাছা কাছি সব লাগেজই আল্লাহ পাইয়ে দিলেন। সব আল্লার ইচ্ছা, আমরা আর কতটুকু বুঝার ক্ষমতা রাখি?
কি বিচ্চিরি হযবরল ‘’ কাপড় খুলি লাইতাম নি’’
গাড়ীর জন্য লাইন দিয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না, আমরা পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে চললাম। দুপুর গড়াচ্ছে আমরাও গিয়ে হোটেলে উঠলাম। চাবি নিয়ে যার যার রুমে যাব এই অপেক্ষায় আছি,ঘটল আরেক বিড়ম্বনা। যে লোক আমার রুম মেট হয়েছেন উনার লাগেজ গাড়ি থেকে নামেনি। গাড়ি চলে গেছে অনত্র। উনি তো সহ্য করতে পারছেন না, সবার লাগেজ নামল আমারটা নয় কেন? উনাকে সবুর করতে বলা হচ্ছে। নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে ,সময়ের ব্যাপার মাত্র, ভুলে ওদের অন্য হোটেলে চলে গেছে এগুলো ফিরে আসবে। কে শুনে কার কথা। উনি এক হযবরল পরিবেশের অবতারনা করলেন। বিভিন্ন কাঁচা ভাষা ব্যবহার করে ক্ষান্ত হলেন না, বলে উঠলেন ‘’ কাপড় খুলি লাইতাম নি’’। আসমান ভেঙ্গে মাথায় পড়ল। হজ্ব করতে আসছেন এই কী ভাষা ও ব্যবহার। কী রঙের মানুষ রঙ্গের দুনিয়া। আমি বলব এই অবস্তা হয়েছে পুরুপুরি এজেন্সির সুস্ট পরিচালনার অভাবে। এই পরিস্তিতিতে পড়া থেকে বিরত থাকা যেত। আমি লক্ষ করেছি প্রতিটি পদে পদে সুস্ট পরিকল্পনার অভাব ও দায়িত্বে অবহেলা।
কী সুন্দর শুরু তাই না? মাত্র শুরু হল সার্কাস। যতসব হযবরল।
প্রথম রাত তোয়াফ ও এশা ও ফজর ভালোই গেল। জুহুরের নামাজে যাব সবে মিস্পালা থেকে জম জম টাওয়ার ও হিল্টনের মাজের রাস্তায় উঠব শুধু বাজে গন্ধ নাকে আসতেছে। রাস্তাটা হলুদ ও ভিজে ভিজে। যখন জানতে পারলাম যে রাস্তা দিয়ে হাটছি সকালে সুয়ারেজ পাইপ ফেটে এই রাস্তায় সয়লাব ছিল। মিজাজটা যে কেমন হল ওদেরকে মন থেকে ধিক্কার দিলাম। ওরা কি হেভি ডিউটি বিলচ চিনে না নাকি? কি ঘৃনিত হযবরল পরিবেশ। আর অনেক বলার ছিল সেই দিকে নাইবা গেলাম।
সবাই এক সাথে নাস্তা খাওয়া, দুপুর ও রাতের খাবার খাওয়া। এরি মধ্যে দেখবেন একটা স্বজনপ্রীতি ও লোক দেখান ভাব আপনার চারিপাশে বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে দেখবেন আড্ডাবাজ জমে গেছে, রিয়া কারীর রিয়ার ঝনঝনানি চালাচ্ছে। আপনার দৃস্টি আকর্ষণেরও চেস্টা চলছে ইত্যাদি। একদিন দেখলাম এক লোক তার মোবাইল ফোন থেকে যুবা বয়সের ছবি দেখাচ্ছেন।উনি যে ইস্ট লন্ডনে সামাজিক এক্টিবিস্ট ও কাজ করেছিলেন তার প্রচার করছেন। উনি এইটা শুনাতেও ভুলেন নি যে উনার রুম বুক ছিল সেরাটনে। এজেন্সির মালিক আত্মীয় হওয়ায় তাদের মাধ্যমে আসা, নতুবা উনি এখানে থাকার কথা না। একজন আরেক জনকে টাট্টা মশকরা করছেন। শান্ত, সাম্য, নিখাদ ভদ্র পরিবেশের বড় অভাব চোখে পড়বে।
আপনি পরিস্কার চক্ষে দেখবেন এজেন্সির কিছু বাচাই লোক ওদের সাথে আরাম দায়ক ফ্লোরে থাকছে, যেখানে সর্বক্ষণ বেয়ারা সার্ভিস, খাবার পানির বোতল বা টয়লেট টিসুর কোন অসুবিধা নেই। কিন্ত আপনার ফ্লোর অনেক উপরে। একবার পানি বা টিসু শেষ হলে আর কোন খবর কারোর নেই। টাসাটাসি করে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর লিফট পেয়ে আপনি রুমে যেতে যেতে সুবিদা ভুগিরা আরামে গা ছেড়ে দিয়েছেন এসির নীচে। কেননা উনাদের ফ্লোর যে হাতের নাগালের কাছে। এই সব বৈষম্য দেখে দেখে আপনাকে মেনে নিতে হবে। আপনাকে ‘’হাজী সবুর, সবুর, সবুর’’ গুল্লি প্রতিনয়ত গুলিয়ে খাওয়ানো হবে।
আপনি হয়ত ক্ষনিকের তরে ভাবতে পারেন ওরা হয়ত আপনার চেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে বা আগে বুকিং দিয়েছিল বলে নিচের দিকের ফ্লোর পেয়েছে। কিন্ত অচিরেই আপনার ভুল ভাঙবে। এমনও অনেক লোক পাবেন, আপনার চেয়ে অনেক পরে এসে বুকিং দিয়ে ২/৩ শ পাউন্ড কম দিয়ে এসেছে এবং আরাম দায়ক ফ্লোরে অবস্তান করছে। যদিও আপনাকে প্রথম যখন বুকিং দেন, রুক্ষ ভাবে বলা হয়েছিল আমাদের প্যাকেজ সবার জন্য সমান ও এক দাম।
টাকা পয়সার লেনদেনেও এক অস্বচ্ছতা। আমদের বলা হয়েছিল আমাদের মূল্যবান জিনিস হোটেল রিসেপ্সনে রাখতে পারব। এজেন্সির সৌদির দায়িত্ব প্রাপ্তকে বললাম পাউন্ড কোথায় রাখব? উনি নিজের হাতে নিয়ে হোটেলের ভিসিটং কার্ডে পরিমাণটা লিখে দিয়ে দিলেন। ১০০ পাউন্ড নিজের কাছে রেখে দিলাম। ঐ সময়ে ভাঙ্গিয়ে ৫২০ রিয়াল পেলাম। আর কোন টাকা পয়সা উনার কাছে জমা পাউন্ড থেকে আনার প্রয়োজনই পড়ে নাই। হজ্ব শেষ মদিনায় চলে যাব উনার কাছে পাউন্ড ফেরত চাইলাম ,উনি দিলেন ২’শ পাউন্ড কম। উনাকে চ্যলেঞ্জ করতে বললনে আরকজনের থলের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন হয়ত। সারা রাত চলে যায় ভদ্রলোকের কোন সাড়া শব্দ নেই। এক অশান্তির মধ্যে আমাকে উনি রেখে দিলেন। আমি উনার ফোনের অপেক্ষায় কিন্ত কোন ফোন নেই । পরের দিন চলে যাব মদিনায়। রাত্রে উনাকে ডিনার রুমে পেলাম, উনার কাছে যেতে ২০০ পাউন্ড হাতে দিয়ে আমাকে বললেন আপনি আবার একটু দেখবেন। মিজাজটা কেমন লাগে, আমার হিসেব তো আমার কাছে আছে। তুমি ইতিমধ্যে পাউন্ড ফেরত দিলে কার্ডে লিখে দিবে। এছাড়া বেচারা গতকাল পরিস্কার বললেন অন্য জনের সাথে ভুল করে ফেলছেন। এখন পাউন্ড হাতে দিয়ে এ কেমন কথা !!! উনি আমাকে অতি নিশ্চয়তা থেকে একটা ধুয়ায় মধ্যে ছেড়ে দিলেন। আমি দৌড় তুলে কাবা শরীফে গিয়ে নফল নামাজ পড়ে আল্লার কাছে সাহায্য চাইলাম। এই যে হযবরল অবস্তার মধ্য দিয়ে পাড় হওয়া শুধু পরিচালনাগত দুর্বলতার ছাপ ছাড়া আর কি বলব। এই হযবরল পুরু হজ্ব সিস্টেমটাতেই পরিলক্ষিত।
ট্রান্সপোর্ট মেনেজমেন্ট তো বলব পরিকল্পিত জগা খিচুরি। ইংলিশে প্রকাশ করতে হলে বলব ‘’অরগেনাইসড কেওস’’ ধিক্কার জানাই মন থেকে তাদেরকে, যারা এর দায়িত্বে। এই আধুনিক সময়ে সব কিছুর এত বাহুল্যতা থাকা স্বত্তেও মানুষদের কস্টের কোন সীমা নেই। যা অনায়সে অতি সহজে পরিহার করা যায়।
আমার কপালে আবার জুটল সহ যাত্রী নিয়ে হজে যাওয়া। মাকে নিয়ে ইতিমধ্যে নিজে হজ্ব করছি, স্ত্রীর হজটা বাকি ছিল। আল্লার নাম নিয়ে আবার সেই চিনা জানা বামনের ঘরে অর্থাৎ সেই পুরানো হজ্ব এজেন্সির দ্বারস্ত হলাম। বুঝতে তো আর বাকি রহিল না, হজ প্যাকেজ কত প্রকার ও কি কি ? সেই আগের মতই হজের সাথী জুটে গেল। উনারা আপন জন, মোটামুটি আমার উপরে আস্থাশীল। আমি কিন্ত তারপরও উনাদেরকে হজ্ব বাজার যাচাই করে দেখতে বললাম। কিন্ত আমার মনে মনে সিদান্ত ছিল, উনারা যদি আমি যে এজেন্সিতে যাচ্ছি তার মাধ্যমে না যান, আমি কিন্ত ঐ এজেন্সির মাধ্যমেই যাব। আমার সাথী সেটা জানেন যে আমি আগে ঐ এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছি । তারপরেও উনি আমাকে এক এজেন্সিতে নিয়ে গেলেন, যাদের প্যাকেজ দাম আমদের চেয়ে বেশ কম। কিন্ত আমি এতে কোন উৎসাহ দেখালাম না। তাছাড়া উনি যেখানে নিয়ে গেছেন ওরা বছর দুই আগে কেইস খেয়েছিল। যাক আমার পছন্দের এজেন্সির মাধ্যমে আমাদের যাওয়া হল। আমি মনে প্রানে খুবই খুশী যে, নিকট জন আমার সাথে যাচ্ছেন, মন ভরে ওদেরকে খাওয়াব, ওদের জন্য আমার সীমার বাহিরে যেয়েও সেবা করতে পিছপা হব না।
এই যাত্রায় এয়ারপোর্ট নেমে সিম কার্ড নিলাম খুশী মনে। সামান্য টাকা পয়সা খরচ করেছি আমার সাথীদের জন্য, উনাদের জন্য সিম কার্ডও কিনেছি। কিন্ত সহ যাত্রী সেই টাকা ফিরিয়ে দিবেনই। ওদেরকে প্রথমেই কিছু করা থেকে বঞ্ছিত হলাম। একটু মনে পীড়া হল।
বাসে উঠেছি আমার পিছনের সিটে বসেছেন আমার সাথী ভাই, উনার সিটের লোকের সাথে এমন আলাপ শুর করে দিলেন যে, যেমন উনি স্বাভাবিক জার্নিতে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন। মন অশান্ত থাকবে কত ক্ষনে কাবা শরীফ দেখবেন, চোখে ভাসবে স্নিগদতা , মন থাকবে শতভাগ আল্লার দিকে, মুখে থাকবে তালাবিয়া, কিন্ত উপরন্ত উনি চাচ্ছেন আমি যেন সামনের সিট থেকে উনাদের সাথে খুশ গল্পে মত্ত হই। আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে মন ও ধ্যানকে আল্লার রাহে রেখে তালাবিয়া পড়তে থাকলাম। আর উনারা গল্প করে করেই মক্কা হোটেল পর্যন্ত চলে আসলেন। আমার এই সাথী ভাইয়ের এই যাত্রার আমল আকিদা নিয়ে আমি উদবিঘ্ন হয়ে পড়লাম। উনি যেমন গাড়ীতে তেমন উদ্ভট ব্যবহার শুরু করলেন হোটেলে। এক অপরিচিত রুম মেটের সাথে প্রাথমিক আলাপ করেই উনি ঘোষণা করলেন উনারা দু’জন বন্ধু। আমি হতবাকের উপর হতবাক হতে লাগলাম। বন্ধুতের ঝামেলায় ইবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় কিনা ভাবতে লাগলাম। যেথায় কঠিন নিয়ম নীতির মাধ্যমে চলতে হয়,ঘুম, খাওয়া, কথা -বার্তা, আচার- আচরণ, মেপে মেপে করতে হয়। সেখানে আমার ঐ সহ যাত্রী রুমের মধ্যে উনাদের বিছানা পাশা পাশি নিয়ে বন্ধুত্ব জুড়ে দেওয়া, কেমন যেন একটা অনাকাঙ্কিত হযবরল পরিবেশের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার ঐ সহ যাত্রী আপনজন, উনার সদ্য বন্ধুর কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন আমাদের চেয়ে কম দিয়ে এসেছেন। আমাদের চেয়ে কম! উনি এই জিনিসটা আমাকে জানলেন। আমি বিব্রত বোধ করালাম উনার এইসব দিকে খেয়াল দেবার জন্য এবং খারাপ লাগল। উনি আমাকে শুনানোর মানে কি ? উনি কি বলতে চাচ্ছেন ? আমার জন্য বেশি দিয়ে এসেছেন? যাক সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামালাম না। দিন দুই তিনেক পর মাথায় আসল কোন এক কার্য কারণের প্রেক্ষাপটে যে, আমার ঐ সাথীকে একটু ইশারা করা দরকার উনার কথা বার্তার ব্যপারে। আমি শুধু মুখ থেকে বের করেছিলাম, ‘’কার মনে কখন দুঃখ গেঁথে যায় বলা যায় না’’, আমাদের একটু সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কি বলব! আমি মুখ থেকে বাক্য শেষ করতে পারি নাই, বেচারা আমার সাথে এমন আচরণ করলেন যেন, আমি যদি আর একটা শব্দ বলতাম সে আমার গায়ে হাত তুলত। এই হল অবস্তা! উনি আমার বয়সে ছোট ও সম্পর্কেও ছোট। আর গিয়েছি কোথায়? কি জন্য গিয়েছি? কি হবে একে অন্যের প্রতি ব্যবহার।
আমি বোধহীন পাথর হয়ে পড়ে রইলাম
আমি নিজেকে এত অপমানিত বোধ করলাম যেমন বালির পাহাড় যেভাবে ধ্বসে পড়ে তেমনি আমার সর্ব অঙ্গ অবশ হয়ে ধ্বসে পড়েছে।
জীবনে কোন মানুষ এমন অসহায় ও ব্যথিত হউক সেটা আল্লাহ যেন না করেন। আমি হেন ঘটনার আকস্মিকতায় বেকুব ও কিছু দিনের জন্য মরমে মরে গিয়েছিলাম।
তবে আমি মনে মনে খুশী, ধৈর্য পরীক্ষায় মহান আল্লাহ উনার বাড়ীতে আমাকে পাশ করিয়েছেন। আমি উনাকে একটা টু শব্দ না করে কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে পড়েছিলাম। চোখের পানি আসে নাই, অশ্রু জমাট হয়ে পড়েছিল, ব্যথা ও অবিশ্বাসে পাথর হয়ে পড়েছিলাম। কিন্ত যখন পরের ওয়াক্ত নামাজে গিয়েছিলাম, আল্লাহকে বলেছিলাম আমাকে তুমি এইটা সহ্য করার শক্তি দাও ,হে মাবুদ আমাকে তুমি শক্ত করে দাও, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
এই যে এতসব হযবরল এর কথা বলছি সব কিন্ত পরিহার করা যেত। আমি যদি উনাদের কে সঙ্গ না নিয়ে একা যেতাম বা কোন আমল দার আলিমের সাথে থাকতাম হয়তবা এমন অসভ্য ব্যবহার পেতাম না। তাই চলা ফেরায় সঙ্গী সাথী বাচাই করে চলতে হয়।
আমার বন্ধু শাব্বির নাজমি সাহেব বলে থাকেন যে, আমার জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তাই উনাকে উদ্দেশ্য করে বলি এইগুলি বিচিত্র অভিজ্ঞতা নয় বন্ধু- এইটা হল জীবন চলার পথে হযবরল । ধন্যবাদ সবাইকে—-।
লেখকঃ মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান ( এডভোকেট )/ লন্ডন ২৯.১০.২০২০ ইংরেজি।