বীর মুক্তিযুদ্ধা জনাব আব্দুর রহিম খান সাহেব
স্মরন করি শ্রদ্ধায়-
ভালবাসি আপনার মানবিক গুনাবলি।
এই করোনাকালীন সময়ে বেশ লেখায় মনস্থির করেছি, বিশেষ করে আমার জন্ম স্তান ও ফেলে আসা দেশের কথা নিয়ে ভাবি ও লিখি। আমাদের এলাকার বিখ্যাত মনুমুখ নদী বন্দর ( মৌল্ভী বাজার, জেলায়) নিয়ে লিখেছি। আমি আরও লিখেছি আমাদের এলাকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ফনি স্যারকে নিয়ে। ফনি স্যারের লেখায় তিন আমলের অর্থাৎ বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সময়ে আমাদের অত্র এলাকার যে সব সম্মানীয় বরণীয় ব্যক্তি ছিলেন তাদের কথা ও তখনকার কিছু জীবন চিত্র চলে এসেছে।
কিন্ত এই ডিসেম্বর মাসে মনে টান আসল আমার এলাকার দুঃসাহসিক মুক্তিযুদ্ধা দের নিয়ে লিখতে।আমি শুরু করে দিলাম ফোন নং সংগ্রহ ও যোগাযোগ করতে। প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকদিন চলে গেল। যাক, প্রথমে যাকে টার্গেট করছিলাম কথা বলব বলে, কিন্ত দুঃখের ব্যাপার উনি মানসিক ও শারীরিক ভাবে চরম বিপর্যস্ত। উনার সেই সময় পাড় হয়ে গেছে জীবন থেকে যে, উনি পারবেন দুঃসাহসিক যুদ্ধের বর্ণনা দিতে। উনি হলেন কয়েকবারের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল মসব্বির ( এরশাদ মিয়া) । ঐ সম্মানীয় ব্যক্তির নিবাস হল মৌল্ভী বাজার জেলার মির পুর গ্রামে।
তারপরে যার খুজ নিতে শুরু করলাম উনি হলেন আজ এই আমার লেখার মুল নায়ক জনাব আব্দুর রহিম খান। উনার খবর নিতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন উনি লন্ডনে আবার কেউ বলছেন বাড়িতে। উনার গ্রামে আমার এক আত্মীয়কে খুজে বের করলাম। বিলেত প্রবাসী ছোট ভাই হেলালের কাছে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম উনি দেশে আছেন। সে বলল উনি ওর সম্পর্কে আপন ভগ্নীপতি। আমার খুবই ভাল লাগল এই সম্পর্কটা বের হওয়ায়। কেননা একজন মানুষের সাথে আগে জানা শুনা না থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ সময় চলে যায় আরাধ্য বিষয় বস্তু নিয়ে আলাপ শুরু করতে ।
উনাকে প্রথম ফোন দিলাম ১৫ই ডিসেম্বর, কিছুক্ষন আলাপচারিতায় বুঝে নিলাম প্রানবন্ত মানুষ। আমদের পরিচয় পর্ব শেষ করে আমার উদ্যেশের কথা বললাম। উনাকে বললাম আপনাকে হয়ত বেশ কয়েকবার আমার ফোন করতে হবে। উনি প্রতি উত্তরে বললেন আগামী কাল ১৬ই ডিসেম্বর আমাকে কোন ভাবেই পাবেন না। আমি বললাম তা আমি জানি এর পরে একদিন ফোন দিব।
সেই দিন অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর উনার কাছে যা ছিল আমার জিজ্ঞাসাঃ-
প্রশ্নঃ আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন ?
ঊত্তরঃ আমি ক্লাস ফাইভ থেকে পেপার পত্রিকা পড়তাম। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষমের শিকার ছিলাম আমরা। আমার তখন থেকেই বদ্ধমূল ধারনা জন্মে যে পাকিস্তানিরা আমাদেরকে বিভিন্ন ভাবে লুন্ঠন করে আসছে। যেমন আমি আপনাকে বলিঃ-
দ্রব্য পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান
সরিষার তেল ( ১ লিঃ) = ৩ টাকা——————— ১২ আনা
আমারা বেশী চাউল ফলাতাম তারপরেও
চাউল = ৪ আনা ——————— ২ আনা
তাছাড়া আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের কর্ণফুলী মিলে কাগজ উৎপাদিত হয়ে প্রথমে যেত পশ্চিম পাকিস্তান এবং সেখান থেকে আসত পূর্ব পাকিস্তানে। আমদেরকে এই কাগজ কিনতে হত অনেক চড়া দামে।
পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের উন্নয়ন কিছুই ছিল না। আমাদের না ছিল রাস্তা ঘাট, না ছিল বিদ্যুৎ। অন্ধকার ঘন জঙ্গলেই ছিল আমাদের পুরু পূর্ব পাকিস্তান।
প্রস্নঃ আপনি কোন বয়সে যুদ্ধে গিয়েছিলেন ?
ঊত্তরঃ আমি ১৯৭০ সালে মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করি। আমার সহপাঠী ছিল ইছা পুরের মরতুজ ও ফজলু । মেট্রিক দিয়ে মাত্র ঢাকায় হাবিব উল্লা কলেজে ভর্তি হয়েছি, তখন শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের দামামা। আমার বয়স তখন ১৬ ছিল। বাড়িতে কাউকে না বলেই পাশের গ্রামের মসব্বির ভাইয়ের সাথে যোগ দেই। বিশেষ করে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি নাই।
প্রশ্নঃ আপনি আপনার মাতা পিতাকে বলে গিয়েছিলেন? উনাদের মতামত কি ছিল?
উত্তরঃ না, আমি কাউকে বলে যাই নাই। আমার আব্বা আমাকে ১৮ মাসের রেখে মারা যান। উনি সারং ছিলেন। আমার আম্মাকে আমি না বলেই চলে যাই। আমি এমনই মানুষ তখন থেকে এখন পর্যন্ত, কোন ভাল কাজে যেতে হলে কাউকে বলি না। আমি যেকোন ভাল কাজ করতে চাইলে একাই ঝাপিয়ে পড়ি। যেমন একটা মসজিদ বা ঈদগাহ তৈরি করতে হবে বা কোন মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে ইত্যাদি।
আরেকটা জিনিষ হল আমার বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে, আমি সবাইকে সমান চোখে দেখি।
আজ ২০শে ডিসেম্বর উনাকে আবার ফোন করলাম। উনার কাছ থেকে যে সব তথ্য নিলাম তা আপনাদের সকাশে তুলে ধরছি।
প্রশ্নঃ আপনার প্রথম যুদ্ধ কোথায় ছিল?
ঊত্তরঃ আমি ১ম সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হই সমশের নগরে। সেই যুদ্ধে আমরা ২২ জন পাকিস্তানিকে হত্যা করি। ওরা সেখান থেকে পিছিয়ে সাদি পুর এসে আস্তানা করে। এরপর আমাদের সেক্টর কমান্ডার সি. আর. দত্ত সাহেব, আমি, মসব্বির ভাই ও সৈয়দ মহশিন আলি সহ অন্যান্যকে শেওলায় এসে ডিফেন্স করতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্ত সেখানে আমরা পাকিস্তানি আর্মির সাথে ঠিকে থাকতে পারি নাই। সেখান থেকে আমাদেরকে জিপ নিয়ে ইন্ডিয়ার কৈলাশ শহরে চলে যেতে আদেশ করা হল। আমরা যথারীতি সেখানে চলে যাই।
প্রশ্নঃ আপনি ট্রেনিং কোথায় পেলেন?
উত্তরঃ আমাদের কে প্রথমে ইন্ডিয়ান এক ব্রিগেডিয়ায় মৌল্ভী বাজারের প্রাথমিক ট্রেনিং দেন। পরবর্তীতে অন্যান্য ট্রেনিং শেষ করে চাতলা বাগানে ভয়ংকর যুদ্ধ করি। ইন্ডিয়ান আরটিলারি আমদের কে সাপোর্ট করে। পাকিস্তানীদের পরাধস্ত করে পিছে হঠিয়ে দেই আমরা। ওদের কে আক্রমনের পর আক্রমন করে সিলেটের সালুটিকর ওদের ব্যারাকে আমরা কোণঠাসা করে ফেলি। এদিকে হবিগঞ্জের মানিক চৌধুরী বিরাট বাহিনী নিয়ে আসেন, আমরা মিলিত হই।
প্রশ্নঃ আপনাদের যুদ্ধের নমুনাটা কেমন ছিল?
উত্তরঃ আমরা আত্মগোপনে থাকতাম দেশের ভিতরে। খবর পৌছিয়ে দিতাম মুক্তিযুদ্ধের আস্তানায়। আমি কিছু দিন জুতা পালিশের কাজ করছি। বাজারে সব্জি বিক্রি করেছি। কৃষক হয়েছি, মাছ ধরেছি এমন বিভিন্ন পেশায় নিজেকে গোপন রেখে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছি। নিজেকে লোক চক্ষের অন্তরালে রাখার জন্য ভিক্ষুক মহিলার ঘরেও রাত কাটিয়েছি। আমরা মুলত খবরের ভিত্তিতে প্রতি রাতে পাকিস্তানীদের বাঙ্কারে গ্রেনেড হামলা চালাতাম।
প্রশ্নঃ আমাদের এলাকার কে কে ছিলেন আপনার সাথে মুক্তিযুদ্ধে?
ঊত্তরঃ আপনার ইউনিয়নের বাঊর ভাগ গ্রামের কুদরত নামের কম বয়সী একটা ছেলে ছিল আমাদের সাথে। ওকে আমি গত দুই বছর থেকে খুজছি, কিন্ত ওর কোন খবর নেই। এছাড়া আপনাদের সাধুহাটি গ্রামের এক হিন্দু ভদ্রলোক মুক্তি যুদ্ধা ছিলেন, উনার নামটা মনে করতে পারছি না।
আর যারা ছিলেন (১) আব্দুল মসব্বির ( এরশাদ মিয়া) গ্রামঃ মির পুর (২) আমি আব্দুর রহিম খান গ্রামঃ বেক মুড়া (৩) নুরুল কবির চৌধুরী গ্রামঃ নাদাম পুর ( বেকা মুড়া) (৪) গিয়াস চৌধুরী গ্রামঃ বেকা মুড়া ( নাদাম পুর) (৫) আব্দুর রশিদ গ্রামঃ জুমা পুর বা জগত পুর (৬) সুন্দর মিয়া , ইউ.কে গ্রামঃ খার গাও (৭) মরহুম মোঃ ইস্রাইল গ্রামঃ রায় পুর।
প্রশ্নঃ আপনি যে কুদরতের কথা বললেন উনার বাড়ী বাউর ভাগের কোন দিকে বা বাপের নাম কি?
উত্তরঃ আমি কিছুই জানিনা। তবে আমার মনে হয় পরবর্তীতে কোন অনাকাঙ্কিত জীবনে চলে যাবার জন্য হয়ত কেউ মেরে ফেলেছে।
প্রশ্নঃ আপনাকে তো জিজ্ঞেসে করা হল না, আপনি কোন সেক্টরের অধীনে ছিলেন?
উত্তরঃ আমার সেক্টর ছিল ৪ নং এবং আমার কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত ।
প্রশ্নঃ আমি যুদ্ধের সময় আমার মামার বাড়ি শেরপুরে ছিলাম এবং এক দিন প্রচন্ড বোম্বিং ও ফাইটার আকাশে উড়ছিল, সেটা কোন মাস হবে।
উত্তরঃ এটা মার্চ মাসে হয়েছিল।
————
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এখন মনে কিছু না করলে একটু অন্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে চাই।
প্রশ্নঃ আপনার অস্ত্র হাতে নেওয়া কি ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে করেন?
উত্তরঃ অবশ্যই, আমি নিজেকে খুবই স্বার্থক মনে করি যে দেশের জন্য এবং মানুষকে বৈষম্য থেকে উদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি অচিরেই আমার দেশ সিঙ্গাপুরের মত হয়ে যাবে।
ধন্যবাদ, আমি আরেকটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস না করে পারছি না। অনেকেই সংগ্রামের পর ডাকাতিতে নেমে যান এমন কি আমাদের এরশাদ চেয়ারম্যান সাহেবের নামও আসে, এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন।
উত্তরঃ দেখেন আমরা যুদ্ধের সাথে সাথেই অস্ত্র জমা দিয়ে দেই। উনি সহ অনেকেই অস্ত্র জমা দেন নাই। অস্ত্রের কিছু অপ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এরশাদ চেয়ারম্যান সম্বন্ধে এমন ধারনা একেবারে ভুল। উনি খুবই জনপ্রিয় ও কয়েক বারের জন প্রতিনিধি। উনি শুধু একবার মৌল্ভী বাজারের ইনাম উল্লাদের সাথে অর্থ কড়ি নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন ও পাগড়িয়া খার বাড়ীর প্রয়াসে উনাকে আর্মি ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে।
আমি বললাম, যাক আপনার নিজ মুখ থেকে এই ব্যাপারটা শুনে খুবই পরিষ্কার হয়ে গেলাম। আপনার দৃঢ় চিত্ত মন ও মনন আমার খুবই ভালো লেগেছে। আপনার সিংহ পুরুষ চেতনা আমাকে প্রফুল্ল করছে। আমি যদি দেশে থাকতাম তবে আরেক সিংহ পুরুষই হয়ে আপনাদের মত থাকতাম। আমি আশা করছি যখন দেশে আসব তখন দুই ভাই মিলে আন্তরিকতার সহিত এক সাথে বসে চারটা ভাত খাব।
যাক, চলেন এখন চলে যাই একটু ভিন্ন আলাপে।-
আপনি তো আপানার জীবনের অন্য অধ্যায়ের কথা বললেন না, বলবেন কি?
ভাই আমি এক সময় জিয়াউর রহমান সাহেবের স্মরনাপন্ন হলাম। উনি আমাকে সাইপ্রাস পাঠিয়ে দিলেন, সেখান থেকে সৌদিতে যেয়ে অনেক দিন থাকলাম। বাড়ীতে ফিরে এসে ১৯৮৩ সালে আপনাদের লন্ডনে চলে যাই। লুটন শহরে কাজ করি ১৯৮৯ তে দেশে চলে আসি। এখন তেমন একটা বাড়ীর বাহিরে যাই না। তবে খুব সুখেই আছি আল্লার হুকুমে। আমার জন্য আপনি দোয়া করবেন।
প্রশ্নঃ জিয়াউর রহমান সাহেব কে আপনি কি বলেন?
উত্তরঃ উনি আর্মি মুক্তি যুদ্ধা । যিনি জেড ফোরস করেছিলেন উনার নামের সাথে মিলিয়ে। আমি জানতাম এই লোকটা একদিন ক্ষমতা নিয়ে যেতেও পারেন।
—-
আমিও উনার কাছ থেকে দোয়ার দরখাস্ত রেখে শেষ করলাম । এবং এই প্রান্তে এসে পাঠক সমাজের কাছ থেকেও দোয়া চেয়ে সমাপ্তি রেখা টানতে চাচ্ছি, কিন্ত একটা রেশ থেকে গেল, — ঐ যে কুদরত নামটা !
একজন মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন, কিন্ত কেউ জানেনা কার ছেলে কার নাতী বা কি হয়েছে তার পরিনিতি। শুধু জানে তার গ্রামের নামটা। আমি বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করেছি , সবাই একি নাম মুখে নেয়। সবাই জানে উনি মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। কিন্ত কেউ রাখেনি তার খবর। আমার জানতে ইচ্ছে করে রাস্ট জানে নাকি?
একটা গানের বেদনাময় বিউগল মনে বাজতেছে অবিরত।
”সব কটা জানাল খুলে দাও না
আমি গাইব গাইব বিজয়ের গান
ওরা আসবে চুপি চুপি—-”
—————– সমাপ্ত——————–
( ছবিতে বীর মুক্তিযুদ্ধা আব্দুর রহিম খান ও উনার সাথে আমি দুরালাফোনে ২য় ছবিতে )
লন্ডন ২০.১২.২০২০ ইং