যখন কোন বাতিলপন্থী অনেক গর্ব, অহংকার, ঔদ্ধত্য, ও শক্তি নিয়ে জগতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, তখন মানুষ তার পতন বা মৃত্যু কামনা করে। এবং তাদের মৃত্যুতে দুইটা বড় বিভৎস বিষয় দুনিয়ায় ঘটে। প্রথমতঃ তাদের জন্য আসমান জামিন কাঁদেনা, ফামা বাকাত আলাইহিমুস সামাউ ওয়াল আরদ্ব। আরেকটা বিষয় হলো তার মরণটা মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনা, তাই আল্লাহ ঐ ব্যক্তির কিছু দৃশ্য মানুষকে দেখায়ে দেন যাতে মানুষের প্রতীতি জন্মে, ফালইয়াওমা নুনাজ্জিকা বিবাদনিকা লিতাকূনা লিমান খালফাকা আয়াহ।
দেওয়ানবাগীর ব্যাপারে আমার এইটেই মনে হচ্ছে এই সকালে। তিনি যদি ইন্তেকাল করে থাকেন আল্লাহর কাছে দুয়া করি ‘মুস্তারীহুন ওয়া মুস্তারাহ’ তিনি নিজেও আরাম নিলেন, আমাদেরকেও আরাম দিলেন। আমাদের মহানবী (সা) অসম্ভব রকমের স্বল্পভাষী ছিলেন, এবং তাঁর কথায় নিগুঢ় অর্থ থাকতো প্রচুর। কিছু লোক মারা গেলে তার এই দুয়ার কত অর্থ হয়, আপনি নিজেও চিন্তা করতে পারেন।
দেওয়ানবাগী সাহেব বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, অসম্ভব রকমের দ্বীনজ্ঞানহীন ছিলেন, তবে ইসলামের বিভিন্ন ঊপদলের চিন্তা দর্শন তার আয়ত্বে ছিলো, তা আমি স্বীকার করি। তিনি মুশাব্বিহা বা মুজাচ্ছিমাহ দের মত আল্লাহর অবয়বে বিশ্বাস করতেন, এবং তারা যেভাবেই বলেছে, “আল্লাহ দেখতে খুব সুন্দর গোঁফ শশ্রুহীন কিশোর বালকের মত”। তিনি এটা মনে করতেন না শুধু, তিনি এটা দেখায়েছেন ও তার শাগরিদদের। একবার তার বিবির নির্দেশে ঘরের ভেতর মীলাদ করার সময় আল্লাহ ও মুহাম্মাদ কিভাবে নেমে এসেছিলেন তা তার আলোচনায় আমি শুনেছি, কিংবা তার পত্রিকায় ও পড়েছি।
চট্টগ্রামের ডঃ প্রফেসর মুইনুদ্দীন স্যারের সাথে চুনতিতে আমি একবার মাহফিল করি। সারা রাত তাঁর সাথে ছিলাম, সকালে এক সাথেই আমরা চিটাগাং আসি। তাঁকে পেয়ে অনেক কথা জানার ও বুঝার সুযোগ হয় আমার। দেওয়ানবাগী সম্পর্কে তিনি আমাকে অনেক অনেক তথ্য দেন। যা শুনে আমি শুধু হতভম্ব হয়নি, রীতিমত ভীত হয়ে পড়ি।
তিনি বলেনঃ দেওয়ানবাগীর সামনে যে সব মুরীদরা বসে তারা শিক্ষাও পেশার জগতে বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা। স্যার নিজ চোখে দেখেছেন শত শত বিশ্ববিদ্যালয় টিচার ও আইনজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের সমারোহ তার অপবিত্র দরগাহে। স্যার আমাকে বলেছেন, শুধু মুসলিম না বহু অমুসলিমের ও সমাগম হয় তার চার পাশে। কারণ তার সম্মোহনী আলোচনা, আধ্যাত্মিক দিব্যদৃষ্টি ও জীবন পরিবর্তনের যাদু, “সবচেয়ে মজার কথা হলো তার ছোঁয়ায় আল্লাহর উপস্থিতি”। আমি এই কথাটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখ উপরে তুলতেই স্যার গলা খাকারি দিয়ে বললেনঃ “উনি কাওকে তাওয়াজ্জুহ দিয়ে বুকে হাত রাখলেই বুক থেকে অনবরত স্পন্দিত গান হতোঃ আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ”। আর সেই শব্দ এমন ‘দপদপানিতে’ বের হত যে আশে পাশের সবাই বুঝতে পারতো এবং সবাই অভিভূত হয়ে যেতো। স্যার বললেনঃ আজাদী সাহেব, আমি অনেক হিন্দুদের ক্বলবেও এই আল্লাহ নামের যিকির জারি হতে দেখেছি ও শুনেছি। আমি ভয় পেলাম, তাহলে সুফি সাধকদের যে সব মাজযুবীয়াত বা শাতাহাত আমরা পড়েছি, দেখেছি বা শুনেছি তারই আধুনিক রূপরে দেখি, স্যার।
দেওয়ানবাগী আল্লাহর সাথে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন, বিশ্বচরাচরে তার স্বদম্ভ হস্তক্ষেপে মাওলাও নাকি নাচার হয়েছেন কয়েকবার, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছেন ও অনেক – এ’ কথার প্রগলভ উচ্চারণ দেওয়ানবাগীর ভিডিও ক্লিপে সবাই শুনেছেন। আমাদের সম্মানের মিনার, ভালোবাসার পবিত্র ফুল, মুমিনদের নয়নের মণি সায়িদাতু নিসাই আহলিল জান্নাহ ফাতিমা বিনতে রাসূলিল্লাহ (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম) নাকি তার স্ত্রী ছিলেন শুনে হেসেছি অনেকবার। এবং সেইদিন ই বলেছি এ এমন এক বদ্ধ উন্মাদ, যার কথা শোনার সাথে সাথে সেই দেশের সরকারের উচিৎ ছিলো তাকে মানুষের জগৎ থেকে সরিয়ে দেয়া। যেমন ভাবে আব্বাসী খলিফা মানসূর সরিয়ে ছিলেন নূহ ইবনে মারইয়ামকে।
অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, শায়খ, আমাদের মহানবী ছিলেন সৌন্দর্যের আধার, ছিলেন পৌরুষের মহিমা, ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও মনোহর। আমাদের নবী (সা) এর ঘাম ও হতো মিশক আম্বরের চেয়ে লক্ষগুণ বেশী সুবাসিত। আমাদের নবীর (সা) শরীর থাকতো পবিত্রতায় ভরা। পোশাক আশাকে তিনি কখনো অরুচির পরিচয় দেননি। ময়লাকে তিনি দেখতে পারতেন না, কোথাও থাকলেও তা সরিয়ে দিতেন। সেই নবী (সা) কে স্বপ্নে যদি কেও রাস্তার পাশে ময়লা ভরা ডাস্টবীনে পড়ে থাকতে দেখেন। যদি কেও স্বপ্নে তাকে দেখে তাঁর পবিত্র দেহে শুধু ময়লা আর ময়লা; দেখে দূর্গন্ধ-প্রিয় মাছিরা সেই দেহের উপর ছেয়ে রয়েছে, তাহলে এই স্বপ্ন নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?
আমি অনেক ঘেঁটেছি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বুঝতে। বিখ্যাত তাবি’ঈ মুহাম্মাদ ইবন সিরীন ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো আলিম যিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যার উপর ‘তাফসীরুল আহলাম’ নামে সুন্দর একটা বই আমাদের উপহার দিয়েছেন। এই বই তে তিনি উল্লেখ করেছেন, পাপী লোকেরাও আমাদের নবী (সা) কে স্বপ্নে দেখতে পারে। তবে তার পাপের প্রকৃতি অনুযায়ীই সে আমাদের নবীকে (সা) দেখতে পারবে।
এই বুদ্ধিবৃত্তিক মূলনীতিটাই দেওয়ানবাগী নামক হতভাগার স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমি বুঝেছি। ময়লা ডাস্টবীনের এই কীট তার আকন্ঠ ডুবিয়ে জীবন যাপন করেছে ময়লার ভাগাড়ে। চিন্তায় দিয়েছে ময়লার ভান্ড উগরে, কাজে দিয়েছে ময়লার জীর্ণতা, মিথ্যার বেসাতি ছিলো তার প্রতিটা আলোচনায়, আর বাতিলের কাহিনী ছিলো তার প্রতিটি জলসায়। তার দিকে তাকায়ে দেখলে দাজ্জালের মূরতি মনে হত, যার চেহারা দেখে আল্লাহর কথা তো মনে হয়নি কোনদিন, বরং উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে দুনিয়া পুজারীর এক নোংরা পোট্রেইট। সেই ব্যক্তি মহানবী (সা) কে স্বপ্নে দেখে। এই ব্যক্তিকে বাংলাদেশে বিরাট সূফী সাধক বলা হত। তার সামনে মোহিত হয়ে নাকি বসে থাকতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগণ, কিংবা উন্নত পেশার বহু জ্ঞানী গুনী মহাজন, অথবা নানা ধর্মের ধর্মচারীগণ। বাংলাদেশে, আমার প্রিয় জন্মভূমিতে সব কিছুই যে সম্ভব!!!
মহানবীর (সা) শিখিয়ে দেয়া দুয়াটাই এই সাত সকালে পড়ে নেই, মুস্তারীহুন, ওয়া মুস্তারাহ।
লেখক : ড۔ মাওলানা আব্দুস সালাম আজাদী
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ইসলামিক স্কলার