অনলাইন ডেস্ক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগের দাবিতে গতকাল বুধবার বিকেল ৩টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। ভিসি-কে পদত্যাগ করার জন্য বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এর মধ্যে ভিসির পদত্যাগের কোন ঘোষণা না আসায় বুধবার বিকেল ৩টা থেকে ভিসির বাসভবনের সামনে ৯ জন ছাত্রী ও ১৫ জন ছাত্রসহ মোট ২৪ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করে।
এদিকে, দুপুর ১২টায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষার্থীদের অশালীন মন্তব্যের অভিযোগে প্রধান ফটকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়া কোষাধ্যক্ষ ও শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে শতাধিক শিক্ষক রাত পৌনে ৯টায় ভিসির বাসভবনের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কাছে আসেন। তারা অনশন ভাঙানো এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের দাবির বিষয়ে একমত কিনা সেই বিষয়ে উত্তর জানতে চান। তবে পদত্যাগের দাবির বিষয়ে কোনো উত্তর না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কথা বলার সুযোগ দেননি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর শিক্ষকবৃন্দ অনশনস্থল ত্যাগ করেন। এছাড়া, আগামী ২ ফেব্রুয়ারির সিন্ডিকেট নির্বাচন স্থগিত করেছে প্রশাসন। এদিকে, বিকেলে সার্বিক বিষয় নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ও ডিনবৃন্দ আলাদাভাবে বিবৃতি প্রদান করেন।
গত রোববার শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদসহ প্রক্টরিয়াল বডি এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালকের পদত্যাগের পাশাপাশি পুলিশের দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। পদত্যাগের ঘোষণা না আসায় ২৪ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেন এবং পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জানান।
এদিকে, রাত পৌনে ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাশের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট সদস্য, অনুষদের ডিন, বিভাগের প্রধানসহ প্রায় শতাধিক শিক্ষক ভিসির বাসভবনের সামনে আসেন। অনশনস্থলে এসে তারা শিক্ষার্থীদের সাথে সহমর্মিতা প্রদর্শন করেন এবং তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু, শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে জানতে চান তারা ভিসির পদত্যাগের দাবির বিষয়ে একমত কিনা? কিন্তু শিক্ষকবৃন্দ সরাসরি একমত পোষণ করতে না চাইলে শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা শুনেননি। শিক্ষার্থীরা বলেন, ভিসির পদত্যাগের সাথে একমত হলেই শিক্ষকদের কথা শুনবেন ও আলোচনা করবেন তারা। কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড, তুলসি কুমার দাশসহ অন্য সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দ কথা বলার চেষ্টা করলে কথা না শোনার জন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় হ্যান্ডমাইকে শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং শিক্ষকবৃন্দ বলেন, ‘এই ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষক, ভিসি স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারবে না। হামলার বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। এই ঘটনায় জড়িত থাকলে ভিসিকে চলে যেতে হবে। কেউ গুলি মারা, বোমা মারায় সংশ্লিষ্ট থাকলে তাকে চলে যেতে হবে।’ এ সময় মামলায় শিক্ষার্থীদের কিছু হবে না বলে আশ্বস্ত করেন তারা। এছাড়া, অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ করেন এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে এক সাথে খাবার আয়োজনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু, শিক্ষকদের সেই প্রস্তাব না মানায় শিক্ষকবৃন্দ সাড়ে ১১টায় অনশনস্থল ত্যাগ করেন।
সার্বিক বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ॥ গতকাল বুধবার বিকেলে রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং রোববারের ঘটনা নিয়ে বক্তব্য প্রদান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, রোববার বিকেলে ভিসি নির্ধারিত ডিন মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য বের হলে শিক্ষার্থীরা ভিসি কার্যালয়ের সামনে পথ আটকে দেয় এবং তাঁেক শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে উদ্যত হয়। এ সময় প্রাণ রক্ষার্থে ভিসিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইআইসিটি ভবনে আশ্রয় নেন এবং শিক্ষার্থীরা তাদের তালা মেরে আটকে দেয়। শিক্ষকরা ভিসিকে মুক্ত করতে আসলে শিক্ষার্থীরা কোষাধ্যক্ষকে লিখিত বক্তব্য নিয়ে আসতে বলেন এবং কোষাধ্যক্ষ দাবি মেনে নিয়ে ভিসির কাছে যাওয়ার জন্য তালাবদ্ধ গেইট অতিক্রমকালে হঠাৎ অস্থিরতা তৈরি হয় এবং এক পর্যায়ে উপস্থিত শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আহত হন। পুলিশের ভাষ্যমতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিলেও ভিসির উপর হামলার দায় বর্তাবার চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সকলের সহযোগিতা কামনা করে প্রশাসন।
ডিনদের বিবৃতি ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েকদিনে সংঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রেক্ষিতে ও বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনবৃন্দ।
বুধবার বিকালে বিজ্ঞপ্তিতে ডিনবৃন্দ বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েকদিনে সংঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হওয়ায় আমরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনবৃন্দ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী লাঞ্ছিত হওয়ায় আমরা মর্মাহত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্কের চরম অবনতি হচ্ছে বলে আমরা মনে করছি। বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অগ্রগতি ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে সকলের পারস্পরিক সহযোগিতা কামনা করেন ডিনবৃন্দ। বিবৃতিতে ডিনদের মধ্যে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার, অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম, অধ্যাপক দিলারা রহমান, অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. রোমেল আহমেদ, অধ্যাপক ড. কামরুল ইসলাম।
শিক্ষকদের মানববন্ধন ॥ শিক্ষার্থীদের ‘অশালীন মন্তব্য’র অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষকরা। গতকাল বুধবার দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অর্ধশতাধিক শিক্ষক প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী শিক্ষকদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করছে শিক্ষার্থীরা। হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। আমরা এর প্রতিবাদে এখানে দাঁড়িয়েছি এবং তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি’। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই সাধারণ শিক্ষক। আমরা সম্মানটুকুর জন্য শিক্ষকতা পেশায় এসেছি, আমরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে বিলং করি, আমরা চাষাভুষা নই, যে আমাদের যা ইচ্ছে তা বলবে। দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। আমরা সেই বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে কেন আজকে অপমানের শিকার হবো। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’ পুলিশের হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, হামলা কে বা কারা করেছে আমরা জানি না। এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিৎ, রাষ্ট্র সেই তদন্তভার গ্রহণ করতে পারে। সেই রাষ্ট্রের কাছে আমরা আজকে নিরাপদ পরিবেশ চাচ্ছি।’ এ সময় শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আবেদিন বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ নারী এবং পুরুষ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অশালীন মন্তব্য করেনি। যদি কেউ করে তাহলে তারা বাইরের, আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং শিক্ষকদের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় আমাদের ছাত্রীদের উপর পুলিশি হামলার পরও শিক্ষকবৃন্দ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি, যা আমাদের মর্মাহত করেছে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সিন্ডিকেট নির্বাচন স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট নির্বাচন স্থগিত করেন।
সাবেক শিক্ষার্থীদের একাত্মতা ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে এবার সাবেক শিক্ষার্থীরাও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বুধবার সন্ধ্যায় তারা নগরীর চৌহাট্টাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি ও সমাবেশ পালনকালে এ ঘোষণা করেন। এ সময় তারা হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যানারে বিভিন্ন দাবি দাওয়া লিখে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষার্থীরা শাবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে ভিসিকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। এ সময় বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচরণের প্রেক্ষিতে তিনদফা দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জল ঘোলা করার পর সেই প্রভোস্ট পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, লাঠিচার্জ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা এখন ভিসির পদত্যাগ চাইছে। আমরাও তাই চাই। সাবেক শিক্ষার্থীরা বলেন, উপবাসী শিক্ষার্থীদের জীবন ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ভিসিকে পদত্যাগ করতেই হবে।