কারাগার, বাসা, হাসপাতাল। গেল অনেকগুলো বছর এটাই ছিল খালেদা জিয়ার জীবন। দীর্ঘদিন পর রাষ্ট্রীয় মঞ্চে দেখা গেল তাকে। এক যুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও যোগ দেন এই অনুষ্ঠানে। তারা দু’জন কুশল বিনিময় করেন। পাশাপাশি বসে কথা বলেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নাহিদ ইসলাম, মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদও খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। রাজনীতিবিদ, সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, নানা পেশার মানুষ আলোকিত করেন সেনাকুঞ্জ।
সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়া যখন আলাপ করছিলেন সে মুহূর্তে গণবিক্ষোভের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ভারতে কী করছিলেন তা জানার উপায় নেই। তবে নিয়তির পরিহাস যে কতোটা নির্মম হতে পারে তা হয়তো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অনুভব করতে পারেন। শেখ হাসিনা বনাম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে এই বৈরিতা দীর্ঘদিনের। তবে ‘যুদ্ধের’ মধ্যেও এক ধরনের শান্তির নীতি তারা অনুসরণ করে আসছিলেন। তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হতো কম। সৌহার্দ্যও হয়তো ছিল না। কিন্তু একে- অপরকে দীর্ঘদিন জেলের বাইরে সহ্য করেছেন। যদিও শেখ হাসিনা তার ওপর গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপি সরকারকে দায়ী করেছেন। তবে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। পরে তিনি নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলেও কার্যত ছিলেন বন্দি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরও শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলের কোপ পড়ে। তাকে প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হয়। সুদখোরসহ নানা উপাধি দিয়ে তার ওপর আক্রমণ শানান শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। আদালতের ‘খাঁচায় বন্দি’ নোবেল জয়ীকে দেখে সারা দুনিয়া। ৫ই আগস্ট দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দ্রুতই মুক্তি মেলে খালেদা জিয়ার। ফ্রান্সে অবস্থানরত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাবছিলেন দেশে ফিরে তাকে কারাগারে যেতে হয় কি-না? কিন্তু মাতৃভূমি থেকে তার ডাক আসে সরকার প্রধান হওয়ার।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়া যখন গতকাল কুশল বিনিময় করছিলেন তখন অনেকে ভাবছিলেন বছর দুয়েক আগে তাদের নিয়ে শেখ হাসিনার করা একটি মন্তব্যের কথা। ২০২২ সালের ১৮ই মে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কার্যালয়ে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল আওয়ামী লীগ। গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি সে আলোচনায় যোগ দেন শেখ হাসিনা। সেদিনের বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করালো ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে।” ওইদিনের বক্তব্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “খালেদা জিয়া বলেছিল যে, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, কারণ বিভিন্ন স্প্যানগুলো যে বসাচ্ছে, ওটা ছিল তার কাছে জোড়াতালি দেয়া। তো বলছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে তার কিছু দোসররাও। তাদেরকে কি করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে যেয়ে, ওখান থেকে পদ্মা নদীতে টুস করে ফেলে দেয়া উচিত।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়াকে পদ্মা নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু রাজনীতির মঞ্চ কখনো কখনো রোমাঞ্চকর এবং নিষ্ঠুর। সেই মঞ্চ কাল পাশাপাশি কুশল বিনিময়ের সুযোগ করে দিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের দুই আলোচিত ব্যক্তিকে। যখন দিল্লির কোথাও বসে শেখ হাসিনা হয়তো হিসাব মেলাচ্ছেন! কোথা থেকে কি হয়ে গেল! যদিও রাজনীতির পণ্ডিতরা তাকে বার বারই হুঁশিয়ার করছিলেন বহুদিন ধরেই। বলেছিলেন, সব দরজা-জানালা বন্ধ করতে নেই। সমঝোতার কিছু পথ খোলা রাখতে হয়। না হয় শেষ পর্যন্ত কোনো হিসাবই মেলে না। আওয়ামী লীগ নেতারাই এখন বলছেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন আয়োজন ভুল ছিল! কিন্তু শেখ হাসিনা যখন মসনদে ছিলেন তখন কেউ হয়তো তাকে সেটা বলার সাহস পাননি। অনুগত মিডিয়াও কেবল তোষামোদ করে গেছে। মনে করিয়ে দেয়নি রাজনীতিতে এক সময় থামতে হয়।
শেখ হাসিনা এখন কোথায়? ক’দিন আগেই ভারতীয় মিডিয়া খবর দিয়েছিল, নয়াদিল্লির লোধি গার্ডেন এলাকায় বাংলোতে আছেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ বিবিসিতে সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ লিখেছেন, ‘আসলে আজ থেকে ঠিক একশ’ দিন আগে আগস্টের ৫ তারিখে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা যখন ভারতে পা রাখেন, দিল্লির বিশ্বাস ছিল তার এই আসাটা একেবারেই সাময়িক- ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাওয়ার আগে এটা একটা সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির বেশি কিছু নয়! যেকোনো মুহূর্তে তৃতীয় কোনো দেশের উদ্দেশ্যে তিনি রওনা হয়ে যাবেন, এই ধারণা থেকেই প্রথম দু-চারদিন তাকে (সঙ্গে বোন শেখ রেহানাকে) রাখা হয়েছিল দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটির টার্মিনাল বিল্ডিংয়েই, যেটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ভার দেশের বিমান বাহিনীর। কিন্তু চট করে শেখ হাসিনার তৃতীয় কোনো দেশে পাড়ি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ভারত সরকার তাকে হিন্ডন থেকে সরিয়ে আনে দিল্লির কোনো গোপন ঠিকানায়। পরে তাকে হয়তো দিল্লির কাছাকাছি অন্য কোনো সুরক্ষিত ডেরাতে সরিয়েও নেয়া হয়েছে- কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি।’